সোনার দেশ জিম্বাবোতে
প্রদীপ কুমার বিশ্বাস
সেই সময় গ্রানাইট পাথরে
হোঁচট না খেলে আমরা শুধু হতাশ হয়ে হয়তো ফিরে চলে আসতাম। গ্রানাইট পাহাড়ের সোনার
সন্ধান অধরাই থাকত। তবে সেদিন মেঘলা আকাশের দরুন জিপিএস ভুল করতে করতে আমাদের
রাস্তা ভুলিয়ে দেয় এবং আমরা রাত কাটাই চিতাবাঘের গুহার কাছে।
আমরা যে ভারতীয়
কোম্পানির হয়ে জিম্বাবোতে সোনা অনুসন্ধানে এসেছি, এই দেশে তারা কয়েক পুরুষ ধরে অন্য
জিনিসের ব্যবসা করেছে। জিম্বাবো সত্যি করে সোনা আর হিরের দেশ। এক টন পাথরে এখানে
কুড়ি-তিরিশ গ্রাম সোনা অনায়াসে পাওয়া যায় নদীর বালুতটে আর পাহাড়ের তলায়। এক সপ্তাহ
এসব দেখে আমদের তো তাক লেগে গেল।
এখানে আসার আগে আমরা একটা
প্রাথমিক অনুসন্ধান করে নিয়েছিলাম ভারতে বসেই। প্রসঙ্গত বলি, সোনা অনুসন্ধানে
ভূতাত্ত্বিক কতকগুলো প্রাথমিক খোঁজ করে নেন। সেই সমস্ত দিকগুলো দেখবার পর আমরা
দেখি কোথায় আগ্নেয়শিলা আছে। অনেক সময় এইসব শিলাতে অন্য ছোটো ছোটো আগ্নেয় পাথরের
অজস্র শিরা আড়াআড়িভাবে কেটে যায় আর দেখা যেতে পারে কখনও ধূসর কোয়ার্টজ পাথর। এই
পাথরে, এমনকি তার সঙ্গের পাথরেও থাকতে পারে মূল্যবান হলুদ ধাতু সোনা। সঙ্গ দোষ
থুড়ি গুণ আর কী!
আমরা ভারতে বসে দিনের পর
দিন জিম্বাবোয়ের উপগ্রহ চিত্রে খুঁজে বেড়িয়েছি এইরকম পাথরের পাহাড় কোথায় আছে, আর তাতে ধূসর কোয়ার্টজ
পাথর পাবার সম্ভাবনা কতটা হতে পারে। এইভাবে আমরা বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছিলাম।
এর সাথে আর একটি কথা আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছিল। এরকম প্রায় সব জায়গা তো সাদা
চামড়াদের কবলে। আমদের এমন কোনও সেরকম সম্ভাবনাময় জায়গা খুঁজে বার করতে হবে যেখানে
অন্য কেউ এখনও এসে পৌছায়নি। এ জিনিস একমাত্র জিম্বাবো পৌঁছেই করা যেতে পারে।
জিম্বাবোতে আমরা তার
ভূ-প্রকৃতির সাথে পরিচিত হবার সাথে সাথে সে দেশের সরকারি খনি এবং ভূতাত্ত্বিক বিভাগগুলোতে ঘুরে বেশ নিরাশ
হচ্ছিলাম। সোনার সম্ভাবনাময় কোন কোন জায়গাগুলো অন্যের দখলমুক্ত, সেই অনুসন্ধান মনে হচ্ছিল
সোনা অনুসন্ধানের চাইতে শক্ত।
এই করতে করতে আমরা একজন
স্থানীয় ভূতাত্ত্বিকের খোঁজ পেয়ে গেলাম যাদের পুরুষানুক্রমিকভাবে সম্পত্তি
কেনাবেচার ব্যবসাও আছে। যে তথ্যগুলো আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম সেগুলো ওর নখদর্পণে।
অনায়াসে তার প্রামাণ্য দলিলের খোঁজ একের পর এক হাজির করতে লাগল। দেখতে ওকে অনেকটা
হিন্দি সিনেমার জীবনের মতো। ওর খটোমটো নাম পাল্টে আমরা ওর নাম দিলাম জীবন। ও হয়ে
গেল আমাদের দলের নতুন এবং গুরত্বপূর্ণ সদস্য। সকাল দেখে দিনটা বোঝা যায়। এটা মেনে
নিলে আমরা আর যেমন বেরোতাম না, তেমনি সেদিন ওসব একের পর এক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটত না।
সে সময়টা বৃষ্টি হবার কথা
নেই, কিন্তু সকাল থেকে আকাশে
মেঘের আনাগোনা হতে হতে একসময় তারা বেশ আসর জমিয়ে নিল। অকালের বৃষ্টি, একটু পরে থেমে যাবে এই
ভেবে আমরা এগিয়ে চললাম। আমাদের যেতে হবে রাজধানী শহর হারারে থেকে দক্ষিণে দুশো
কিলোমিটার দূরে গ্রানাইট হিল পাহাড়ে। গ্রানাইট একধরনের আগ্নেয়শিলা। নুন আর
গোলমরিচ মেশালে যেরকম দেখতে হয়, অনেকটা সেইরকম এই পাথরের রং। অবশ্য এছাড়া আরও রং আছে, যেমন পিঙ্ক গ্রানাইট।
উপগ্রহ চিত্রে এই পাহাড়টি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল গ্রানাইট পাথরের এই পাহাড়টিতে
বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ধূসর কোয়ার্টজ পাথরের অনেকগুলি পাতলা শিরা হয়তো আছে। সোনা
অনুসন্ধানে এটা আমাদের কাছে খুবই পছন্দের জায়গা। তার উপরে, জীবনের খবর, যে এই পাহাড়ে এর আগে কেউ
কোনও খোঁজ চালায়নি।
আমাদের যাবার রাস্তায়
মাঝে পড়বে কদোমা টাউন। কদোমা থেকে একজন স্থানীয় লোককে আমরা তুলে নেব। এই অভিযানে
ওকে হেডমিস্ত্রি হিসাবে নিয়োগ করা হলেও ও আসলে হবে আমাদের গাইড।
জীবনের কথামতো আমরা এই
অভিযানের উদ্দেশ্য যতটা সম্ভব গোপন রাখা যায় তা রাখছি। সাধারণত এ ধরনের অভিযানে
যন্ত্রপাতি যায় ছোটো ট্রাকে আর আমরা যাই বোলেরোমতো জীপে। কিন্তু জীবন বলল, একসাথে দু-দুটো গাড়ি, এটা কিন্তু অনর্থক দৃষ্টি
আকর্ষণ করবে। রাবল নিয়ে যাচ্ছি ভেবে বিপদ হতে পারে। এখানের ভাষায় রাবল মানে সোনা
আছে এরকম বড়ো বড়ো পাথরের টুকরো। এরকম পাথর নদী আর যে পাহাড়ে সোনা আছে তার তলায়
দেখা যায়। সবাই দেখতে পায় না, কিন্তু কেউ পেলে তখন সবাই তার ওপর আর জায়গাটার ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়ে। ছোটো ট্রাকে গেলে লোকে আমাদের হিচ-হাইকার বলে মনে করবে। তাহলে আর কোনও ঝামেলা
হবে না।
ছোটো ট্রাক মানে বোলেরো
কাম্পেরা গাড়ির চাইতে সামান্য বড়ো। এধরনের গাড়িতে একটা ছোটো টাব থাকে পেছনে। এই
টাবে আছে সপ্তাহ খানেকের রেশন, শুকনো খাবার, ছোটো জেনারেটার, সার্ভের যন্ত্রপাতি, আর আমাদের কয়েকটা সুটকেস। সব মিলে
ওজন কম নয়। এই মাল ভরতি টাবের জন্যে পরে মুশকিল কম হল না।
কডোমাতে সেই লোকটি যাকে আমাদের
আসলে লোকাল গাইড হিসেবে নিয়ে যাবার কথা, হঠাৎ বৃষ্টির জন্য বোধ করি এল না। ও না থাকলেও আমাদের কাছে
জিপিএস, কম্পাস আর টোপোগ্রাফিক
ম্যাপ আছে। তবে একটু অসুবিধে হবে। কডোমা থেকে গ্রানাইট হিল একুশ কিলোমিটার
সাউথ-ইস্ট,
পাঁচ
কিলোমিটার পরে কাঁচা রাস্তা শুরু হবে। সেখান থেকে সাউথ-ইস্টের দিকে ঘুরতে হবে।
আমাদের টোপোগ্রাফিক ম্যাপ তাই বলে। জিপিএস একটু বেশি বলছে। কারও খেয়াল নেই যে
মেঘলা আকাশে জিপিএস একটু খেয়ালখুশি করে। খানিকক্ষণ পরে সেই নিয়ে আরও বেশি হয়রানি
হল। সে কথায় পরে আসছি।
শুরু হল গ্রানাইট পাহাড়
যাবার চুলের কাঁটার মতো পাহাড়ের চারপাশে প্যাঁচ দেওয়া কাঁচা রাস্তা। ষোল কিলোমিটার
এই রাস্তাটাতে চড়াই উতরাই করে, একটা পাহাড় টপকে তবে গ্রানাইট হিলে যাবার রাস্তা আসবে।
জাপানি ট্রাক গজরাতে গজরাতে প্রথম পাহাড়চুড়োতে উঠে এলিয়ে পড়ল। একে বৃষ্টিতে ভেজা
কাদা রাস্তা তার ওপর মালপত্রে ভরতি টাব, একটু বিশ্রাম পেলে ঠিক হয়ে যাবে, আমাদের ড্রাইভার বন্ধু রবার্ট এই
বলে আমাদের আশ্বস্ত করলেও পরে আবার উতরাই পথে জাপানিবাবা কয়েকবার কাশতে কাশতে আবার
বিগড়ালেন। সদা হাস্যময় রবার্ট এবার গম্ভীর মুখে ইঞ্জিনের বনেট খুলে তার স্বাস্থ্য
পরীক্ষায় মন দিলে।
কিছুক্ষণ পরে বড়ো
ডাক্তারদের মতো বললে, “এক-আধঘণ্টা
লাগবে, কিন্তু যদি তাতে না হয়
তবে কী হবে আমি জানি না। তোমরা এত ভারী জিনিস ভরেছ, আমি আগে জানলে অন্য ব্যবস্থা
করতাম।”
আমরা ঠিক করলাম, একঘণ্টায় আমরা যতটা পারি
হেঁটে এগিয়ে যাই। কিছু না হোক গ্রানাইট পাহাড়ের তলায় পৌঁছাতে পারব। মুশকিল হল
আমাদের সব মেশিনপত্র রইল ট্রাকে পড়ে, এসব ছাড়াই যতটা সম্ভব সেটুকু কাজ এগিয়ে থাক।
পাহাড়ি উতরাই রাস্তায়
আমরা নামছি তো নামছিই। প্রায় একঘণ্টা চলেছি, কিন্তু চোখ রয়েছে পড়ে থাকা টুকরো
কোয়ার্টজ পাথরগুলোর দিকে। এগুলো সব এসেছে পাশের গ্রানাইট পাহাড় থেকে। সবাই এসেছে, কিছু গ্রানাইট পাথর
টুকরোও এসেছে,
কিন্তু
আসেনি সে। ধূসর-ধোঁয়াটে রঙের কোয়ার্টজ পাথর, যাতে কোথাও কোথাও আছে সেই
বহুমূল্যবান হলুদ ধাতু, সোনা। চড়া রোদ নিয়ে মাথার ওপরে রবি, প্রায় পাহাড়তলির কাছাকাছি
এসে গেছি আমরা। একটা বড়ো ছায়া দেখে আর লোভ সামলানো গেল না। একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক, আর ম্যাপটা আর একবার দেখে
নিই সকলে বসে। ছটফটে জীবন সবার আগে বেশ অনেকটা দূরে। ওকে হাঁক দিয়ে ডাকলাম সবাই।
জীবন আমাদের ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকাল আর বেচারি তাতে অন্যমনস্ক হয়ে হোঁচট খেল জোর
আর গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। সেই দেখে আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম।
সবাই মিলে গাছের ছায়াতে
বসে কফি আর স্যান্ডুইচ খাচ্ছি, আর জীবনের সাথে মজা করছি। ওর মত শক্ত জোয়ান কীসে এমন হোঁচট
খেল যাতে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে হল? ও নাকি খুব শক্ত কিছুতে আঘাত করেছে। কিন্তু সেই জায়গাতে এত
লতাপাতার জঙ্গল যে ও দেখতে পায়নি। সবাই তখনও বসে। আমার হঠাৎ কী মনে হল, জীবন যেখানে পড়ে গেছিল সে
জায়গার আগাছা সাফ করা শুরু করতেই বেরিয়ে পড়ল নুন-মরিচ রঙের গ্রানাইট। গড়িয়ে পড়া নয়, মাটি ফুঁড়ে এসেছে। সবাই
মিলে এই জায়গাটার আশেপাশের লতা জঙ্গল সরাতেই অনেকটা জায়গা জুড়ে মাটি ফুঁড়ে আসা গ্রানাইট
পাথর বেরিয়ে পড়ল এবং এই পাথরকে ছোটো ছোটো কোয়ার্টজ পাথরের স্তর চিরে গেছে। এটা যে
পাশের গ্রানাইট পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে তাতে আর কোনও সন্দেহ রইল না।
অবশেষে একটু নিচের দিকে
যেতেই পাওয়া গেল ধোঁয়াটে সাদা রঙের সেই কোয়ার্টজ পাথর এবং তার সাথে পাতলা চুলের
মতো উজ্জ্বল হলুদ সোনা এবং ছোটো দানা দানা, সোনার নাগেট। যদি আরও নিচে গিয়েও
বেশ কয়েক জায়গাতে এইরকম পাথর আমরা পাই তাহলে একদম নিশ্চিত হওয়া যাবে যে এই পাথর
গ্রানাইট পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। তাহলে তো আমরা এক বিশাল কিছু ভাণ্ডারের সামনে!
দারুণ চার্জড হয়ে আমরা নিচে নামতে শুরু করলাম। পাহাড়ের নিচটায় গভীর জঙ্গল। সেইখানে
একটা ব্যাপার ঘটল।
বিশ্রী একটা পচা গন্ধ
নাকে আসায় আমরা যখন রুমাল দিয়ে জোরে নাক চেপে ধরতে ব্যস্ত তখন সবার আগে থাকা জীবন
একটা উঁচু গাছের মগডালে কিছু দেখতে পেল। সকলে এবার দেখলাম মগডালে মরা হরিণ ঝুলছে। জীবন
বলল, লেপার্ড মানে চিতা অনেক সময় শিকার নিয়ে যায় মগডালে, যাতে আরাম করে খেতে পারে। এটা তারই কাজ হতে পারে। মেরুদণ্ড
দিয়ে একটা হিমেল স্রোত চলে গেল। আমরা সবাই নিরস্ত্র, একটা ছুরিও কারও কাছে
নেই। কিন্তু জীবন এমনভাবে আমাদের দিকে দেখছে যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়। কতগুলো শুকনো মোটা গাছের ডাল কুড়িয়ে আনল আর আমাদের
হাতে হাতে দিল। এ দিয়ে কী হবে? ও যেন তৈরি হয়েই এসেছিল। ব্যাকপ্যাক থেকে ডিজেল ভেজানো
কাপড় বার করল। লাঠির গায়ে জড়িয়ে খুব তাড়াতাড়ি মশাল বানাল। এবার বেরলো মানুষের
কিম্ভুতকিমাকার মুখোশ। সবাই এই মুখোশ মাথার পেছনদিকে লাগিয়ে মশাল জ্বালিয়ে এগোলাম দু’পাশে
লম্বা লম্বা গাছের ঘন জঙ্গলের বুক চিরে সাপের মতো আঁকাবাঁকা বনের একফালি শুঁড়ি
রাস্তায়। জীবন চলছিল সবার আগে। আমরা ওর থেকে পিছিয়ে পড়ছিলাম।
এক জায়গায় রাস্তা বড়ো
বেশি এঁকে বেঁকে গেছে। এটা পেরিয়ে যেতেই আমরা লক্ষ করলাম জীবনকে তো আর দেখা
যাচ্ছে না। সবাই মিলে গলা ফাটিয়ে ডেকেও সাড়া পেলাম না। কী হল ওর? ওরও তো উচিত ছিল একবার পেছন
ফিরে দেখা। আরও কয়েকবার চেঁচিয়ে ডেকেও যখন সাড়া পেলাম না তখন মনে কু গেয়ে ওঠছিল। জীবনের সেই ‘আগে গেলে
বাঘে...’ কিন্তু কিছু তো একটা আমরা শুনব! আমাদের মধ্যে একজন ফিসফিস করে বলল, “চিতাবাঘ নাকি নিঃসাড়ে...”
আমরা সবাই তাকে ধমকে
উঠলেও ভয় কিন্তু এবার সবার হতে লাগল। জীবনের জন্যে, আবার নিজেদের
জন্যেও। জীবন সত্যি গেল কোথায়? কিছু পরে তার উত্তরও পেয়ে গেলাম। এমন কিছু পেলাম যা আমরা
ভাবিনি কখনও,
প্রস্তুতও
ছিলাম না কেউই আমাদের মধ্যে। সবার আগে আমি দেখতে পাই সেটা।
সামান্য দূরে একটা বাঁহাতি
সরু রাস্তা এসে মিলেছে এই রাস্তার সাথে। ঠিক সেই মোড়ের মাথা থেকে একটু দূরে
গাছগুলোর আড়ালে একটা মশাল মাটিতে পড়েও জ্বলছে। ওটা যে জীবনের তা যেমন বলার দরকার
নেই আর দরকার নেই কেন ওটা ওখানে পড়ে। এতক্ষণ আমরা প্রাণভয়ে ভীত ছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে সেটা আদিম হিংস্র
মানবের ক্রোধে পরিণত হল। সকলে নিজের নিজের জামা খুলে তৈরি হলাম মশালগুলো আরো মোটা
করতে। বাঘটার
আভাস পেলেই সবাই একসাথে ছুঁড়ে মারব। সবাই মিলে আমরা বৃত্তাকার হয়ে রইলাম একে
অন্যের মুখের দিকে চেয়ে। কোনদিক থেকে শয়তানটা ঝাঁপাবে কে জানে?
একটা ক্ষীণ আওয়াজ আসছে। আরে, এটা তো জীবনের গলা! মনে হচ্ছে
কাছেই, কিন্তু এত লোকের মশালেও তো দেখা যাচ্ছে না। আমরা সবাই মিলে এবার শুনলাম, “হেল্প, হেল্প! আমি এখানে।”
সবাই মিলে এগিয়ে গেলাম। একজন আমাকে পেছন থেকে জাপটে না ধরলে
আমার অবস্থাও জীবনের মতো হত। পড়তাম সোজা পিটের মধ্যে। অবশ্য
একা হতাম না।
অন্ধকারে ও যাতে ঘাবড়ে না
যায় সেজন্য একটা মশাল তৈরি করে তার গায়ে মাচিস বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হল। ও চটপট জ্বালিয়ে নিল। কীভাবে ওকে
উদ্ধার করা যায় সে নিয়ে আমরা বলাবলি করছি, ও দেখি হঠাৎ গায়েব। গেল কথায়? বলতে না বলতে কোথা থেকে মাটি
ফুঁড়ে যেন উদয় হল জীবন। অভিজ্ঞ লোক, আলো পেয়েই বুঝে নিয়েছে এখানে কী কাণ্ডকারখানা চলছিল আর
বেরোবার ঢালু রাস্তাটা অর্থাৎ সাব-ইনক্লাইন ও এডীটটা কোথায়।
এখানে চলছিল কোনও বে-আইনি
খনি এবং সেটা সোনার। পদ্ধতিগত নিয়মগুলো না মেনে খেয়ালখুশিমতো মাইনিং করলে সোনার
ডিম দেওয়া হাঁসের পেটে চাকু মারার মতো হয়। একটু পরে তাতে আর মাইনিং করা যায় না।
এখানেও ঠিক সেই কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বে-আইনি সোনার খনি। আসার সময় দু’হাতে
যে পাথরগুলো এনেছিল তাতে বেশ কিছুতে নাগেট খালি চোখে দেখা যাচ্ছে। টন পিছু কমপক্ষে
বিশ-পঁচিশ গ্রাম সোনা থাকতে পারে।
জীবন যে পিটে পড়ে গেছিল
এবার আমরা তাতে সাব-ইনক্লাইন দিয়ে নেমে আরও কিছু পাথর নিয়ে এলাম। সেগুলো স্যাময়
চামড়াতে রেখে,
হাতুড়ির
হাল্কা ঘা দেওয়া হল কিছুক্ষণ ধরে। চামড়ার টুকরোটা হেলিয়ে ধরতেই পাথর গড়িয়ে পড়ল। সোনার দানা চামড়ার টুকরোতে আটকে
রইল। আমাদের অনুমানের চাইতে বেশি সোনা আছে দেখা গেল।
আমরা যা খুঁজছিলাম তা
পেয়ে গেলাম। বাকি
শুধু গ্রানাইট পাহাড়ে ধোঁয়াটে কোয়ার্টজ খুঁজে পাওয়া। সেটা পাওয়া গেলে ওপর থেকে নিচ
অবধি... ভাবা যায় না। ইচ্ছে তো করছে এখনই উঠে পড়ি, কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে সাহস
আর নেই কারোরই। তার
ওপর প্রকৃতি আবার বিগড়াল। বলতে না বলতে দমকা হাওয়ার সাথে একপশলা বৃষ্টি আমাদের ভেজাল
এবং আরও ভেজাবার হুমকি দেবার জন্য কালো মেঘ আকাশের গায়ে রেখে গেল।
রাতে থাকার ব্যবস্থা জীবন
করেছে সরকারি বন-আবাসে। জিপিএসে তার স্থানাঙ্ক দিতেই পথনির্দেশ দেখা গেল। কিন্তু মেঘের ঘনঘটায় জিপিএস একটু
ভুল করল। আমরা
সেটা যখন বুঝলাম তখন একটু অন্য রাস্তায় চলে এসেছি এক পাহাড়ি ঝর্নার ধারে। প্রায় বিকেল হব হব করছে।

যে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্না, তাতে একটা গুহা। দেখে মনে হচ্ছে গুহাটা
বড়সড়ই হবে। আমাদের সকলের ব্যাকপ্যাকে মিলিয়ে জুলিয়ে যা আছে তাতে অনাহারে রাত কাটবে
না, আর শুকনো কাঠের অভাব নেই। নুডল কাপ বানানো তো যেতেই পারে।
আর হাঁটা যায় না। প্রায় সবাই আমরা এখানেই রাত কাটাবার জন্য রাজি ছিলাম, কিন্তু
জীবন যে যুক্তি দেখাল সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সামনে জলের ঝর্না আর পরিত্যক্ত
গুহা। রাতের
হিংস্র প্রাণীদের আবাসস্থল হতে পারে। গুহার কাছে গিয়ে কিন্তু সত্যি একটা বোঁটকা
গন্ধ পাওয়া গেল। কিন্তু জীবন, আমরা যাই কোথায়? তোমার জিপিএস তো ভুলভাল রাস্তা দেখাচ্ছে।
ঝর্নার মিষ্টি জল খেয়ে
মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল। সবাই সেটা মেনেও নিল। এই ঝর্না ধরে মাত্র আধ কিলোমিটার
নেমে গেলে অবশ্যই থুলি নদী। আমাদের টোপোগ্রাফিক ম্যাপ তো আর
জিপিএস নয় যে ভুল কিছু পথ দেখাবে। কিন্তু তাতে কী? আরে ভাই, বোঝো না কেন? নদী মানেই তার আশেপাশে
গ্রাম বা মানুষের বসতি হতে পারে। রাতের আশ্রয় মিলতে পারে, এমনকি খাবারও হয়তো।
জীবন আর ওর দেশোয়ালি এক
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আমাদের একজন রসিকতা করতে ছাড়ে না। “দেখ গে, হয়তো এদের কারও শ্বশুরবাড়ি
হতে পারে,
কী জীবন!
জামাই আদরের খাবারের ভাগটা দেবে তো? বাকিটা না হয় তোমার জন্যেই...”
এটা দেখছি ইউনিভার্সাল
জোক। দু’জনেই
সাদা দাঁত বের করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে আমরা থুলি নদীর পাড়ের কাছে পৌঁছালাম অনেক
তাড়াতাড়িই আর সেখানে এসে বেশ কিছু নিষ্ঠুর সত্যির সামনে দাঁড়ালাম।
নদী জল দেয়, সুফলা মাটি দেয়, মাছেরও
জোগাড় দেয়। কিন্তু
জিম্বাবোতে নদী এছাড়া আরও কিছু দেয়। পাহাড় আর ঝর্নার পাথরেরা গড়িয়ে গড়িয়ে এসে জমা
হয় নদীর কাছাকাছি। তার
মধ্যে বেশ কিছু পাথরে থাকে সোনা আর হীরে। এই থুলি নদীর কাছে স্বভাবতই থাকবে সোনা
মেশানো পাথর,
স্থানীয়
লোকে বলে রাবল।
নদীর কাছে পৌঁছাতেই
স্বর্ণ সন্ধানী একঝাঁক গ্রামবাসীর দেখা। সারাদিন ধরে ওরা নদীর বালি আর আশেপাশে পিট
কেটে পেয়ে যায় সোনা, বেশ ভালো পরিমাণে সোনা। তবুও ওরা গরিব, বেশ গরিব। তা ওদের সঙ্গের
অর্ধভুক্ত অপুষ্ট শিশুগুলো দেখলে বোঝা যায়। তাহলে সারাদিনে পাওয়া এই সোনা, সেটা তো
কম নয়! আমরা তো একটু আগে জেনেছি। আন্দাজ করতে পারি এরা কতটা পেতে
পারে যদি চার-পাঁচজন মিলে এক টনের কাছাকাছি পাথর ধোয়ামোছা করে, তাহলে?
ওদের একজন আমাদের সত্যি
কথাটা বলল। এইসব সোনা সপ্তাহে দু-তিনদিন মাফিয়ারা এসে নিয়ে যায় দাদন দেওয়া অল্প
পয়সার বিনিময়ে। তাতে
কোনওরকমে ভুট্টাদানা কেনা যায়। এখানে গ্রামের সাধারণ লোক ভুট্টাদানা জলে সেদ্ধ করে
একরকম পুলতিশ মতো জিনিস বানিয়ে খায়। গমের আটার রুটি খেতে পাওয়া বিলাসিতা, পালে-পরবে হয়তো জুটল। সেই
এক শোষণের কাহিনি সব জায়গাতে। জীবন ও তার সাথী নীরবে ঘাড় নেড়ে জানাল যা আমরা শুনছি
সব সত্যি। ওরা হাত তুলে দেখিয়ে দিল অদূরে এক পাহাড়ি টিলার চুড়োতে একটা উঁচু পাঁচিল
দেওয়া একটা বেশ বড়ো বাড়ি। বাইরে থেকে লোক এলে তারা
ওখানেই থাকে, খায়।
আমাদের কাছে কাপ নুডল ছিল। এতে গরম জল দিলেই খাবার তৈরি হয়ে
যায়। আমরা ওদের জন্য কয়েকটা দিলাম। ওরা ওদের বাচ্চাদের খাইয়ে দিল। এক
শ্রমিক রমণী কিছু কাপ নুডল চেয়ে নিল, বাড়ি নিয়ে যাবে তার বাচ্চাদের জন্যে। আমি
ইচ্ছে করে আরও কিছু কাপ নুডল ছেড়ে এলাম। চলে আসার সময় দেখি সেই মেয়েটি কাপ নুডলগুলোর
গায়ে হাত বুলিয়ে দ্রুত ঢুকিয়ে নিচ্ছে তার অ্যাপ্রনের ভেতরের পকেটে। সারাদিনের
ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে যখন পৌঁছাবে তার কুটিরে তখন আজকের চিত্রটা অন্যরকম
হবে। তার শিশুরা হাপুস-হুপুস করে খাবে ধোঁয়া ওঠা কাপ নুডল। মনে হচ্ছে এই ভেবেই তার সারাদিনের
উপবাস ক্লিষ্ট শুকনো মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছে। মায়েরা বোধ করি পালটায় না কোথাও।
দু’পাশে গভীর ঘাসবনের বুক
চিরে, পাকদণ্ডী বাঁধানো পথে টিলার
ওপরে উঁচু পাঁচিল ঘেরা সেই বাড়ির গেটের কাছে যখন পৌঁছালাম তখন পশ্চিম আকাশে একটা
লাল বড়ো গোলা পাটে বসেছে। হালকা আলো আছে। দেশীয় ভাষায় জীবন আর তার সঙ্গী গৃহরক্ষককে
ব্যাপারটা বলতেই গেট খুলে গেল শুধুমাত্র রাত্রের আশ্রয়ের জন্যে। কাল সকালেই ছেড়ে চলে যেতে হবে।
এক ঝাঁকা ভরতি মুরগি আর
ভুট্টার আটা আছে। রাত্রে
খাবার অসুবিধা হবে না। তবে মালিকদের অনুমতি ছাড়া ঘর খুলে দিতে পারবে না। ছাদের
ওপরের ঘরটা ওর,
সেটা ছেড়ে
দেবে। ছাদে ও শোবে। আমাদের
দলের কিছু লোক ওর সাথে সেখানেও শুতে পারে। কাঠের আগুনও থাকবে, শীত করবে না। এখানে দিনে
গরম হলেও রাতে কিন্তু বেশ শীত করে।
গেস্ট হাউসের ঠিক পাশ
দিয়ে একটা পাহাড়ি ঝর্না বয়ে যাচ্ছে। আমরা চাইলে এখনই তাতে স্নান করে
ফ্রেশ হতে পারি। তবে চাঁদ ওঠার আগে সেসব কিছু শেষ করে ফেলাই ভালো।
হঠাৎ চাঁদ ওঠার সাথে
আমাদের স্নানের কী সম্পর্ক? জীবনের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কথাটা বলেই ফেলে সে।
“মানে তেমন ভয়ের কিছু নেই
এখন আর। আগে এই ঝর্নাতে চাঁদের হাট বসে যেত। জ্যোৎস্নার আলোতে বনের সব জীবজন্তুরা
আসত দলবেঁধে। এখন কখনও কখনও আসে কেউ কেউ।”
আমাদের মধ্যে একজন বলে
ওঠে, “কেন? জল তো শুকায় না। এই গরমেও তো দিব্যি বয়ে চলেছে। নাকি আরও কোনও বড়ো ঝর্না আছে?”
সে আমাদের দিকে তাকিয়ে
সাদা দাঁত বের করে হেসে ওঠে, “ঝর্না এ তল্লাটে এই একটাই। জংলি জানোয়াররা সব বেঁচেবর্তে
থাকলে তবে তো। তেনারা
সব আসেন,
সোনা আদায়
করেন, আর শিকারও করেন। তাদের
হাতে মরতে মরতে এক আধটা কেউ কেউ এখন বেঁচে আছে কোনওরকমে। তারাই আসে কখনও কখনও।”
ঝর্নার জলে স্নান করে
আমরা যখন ফিরে এলাম গেস্ট হাউসের আঙিনার টিনের শেডে তখন কাঠের উনু্ন জ্বলছে দু’তিনটে।
রবার্ট গাড়ি ঠিক করিয়ে, মেকানিক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে। সঙ্গে
একবস্তা জোয়ার-গম মেশানো আটা, সয়াবিন তেল আর তেলচুকচুকে কালো রঙের একটা পাঁঠাও এনেছে।
মুরগি আজ অনেকগুলো কেটে ফেলেছে, কালো পাঁঠার সদ্ব্যবহার কাল হবে। আপাতত সে আগুনের অদূরে এক
জায়গায় বাঁধা,
কাঁঠাল পাতামতো
কিছু চিবিয়ে চলেছে।
মেকানিক লোকটি বয়স্ক। ও এখানকার সব পাহাড় জঙ্গল
হাতের তালুর মতো চেনে। এখানের পাহাড় জঙ্গলের গল্প শুনছিলাম আমরা সব। তাকে আমরা যখন
এক জায়গাতে গাছের ওপরে মরা হরিণ দেখার কথা বললাম সে হেসে আকুল।
“এটা কোনও পোচার অর্থাৎ,
চোরাশিকারি বাহিনীর কাজ। ওদিকে আর চিতা কই? এ তল্লাটে একটা চিতার পরিবার ছিল। শুনি একটা তরুণী চিতা আর
তার বাচ্চা দু’তিনটে এখনও বেঁচে আছে। তবে আজ শুনলাম, সে মাদি চিতাটার কয়েকদিন হল
দেখা নেই। বাচ্চাগুলোকে
হয়তো লুকিয়ে গেছে গুহাটায়।”
“গুহাটায় মানে? আমরা একটু আগে সেই ঝর্নার
ধারে...”
মেকানিক বন্ধুটি
তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, “হ্যাঁ, এ তল্লাটে এই ঝর্নার মতো বাঘদের
থাকার মতো তো ওই একটাই গুহা।”
জীবন আমাদের দিকে, বিশেষ করে আমাদের কয়জন
যারা আজ রাতটা ওই গুহাতে থাকবার প্লানিং করেছিলুম, তাকিয়ে বলল, “আমি তো তখনই তোমাদের মানা
করেছিলাম। ভাগ্যিস
তোমরা আমার কথাটা...”
জীবন এটা অবশ্য বলল না যে
চিতার গুহাতে কার জিপিএসের জন্য পথ ভুলে আমরা পৌঁছেছিলাম। মেকানিক ভদ্রলোক বললেন, “ভাগ্য তোমাদের সাথে এই
বিকেলেও ছিল। সেটা না হলে তোমাদের মধ্যে কেউ একজন এখানে আমাদের সাথে গল্প করত না।”
আমি বললাম, “তুমি কী বলতে
চাইছ?”
“দিন দুই আগে হলে সন্ধে হব
হব সময়ে ঘাসের বনের বুক চিরে যে পাকদণ্ডী রাস্তাটা এখানে এসেছে সেখানে একটা চতুর
পুরুষ চিতা অপেক্ষা করত পথভোলা কোনও বাছুর বা ভেড়ার জন্যে। পায়ে চলা তোমরা তো তার
কাছে আরও সোজা শিকার ছিলে। তোমাদের ভাগ্য ভালো, যে তোমাদের একদিন আগে আসা অতিথিরা
তার কপালে কতগুলো বুলেট বিঁধিয়ে দিয়ে তার চামড়াটা হয়ত এখন হারারের বাজারে বিক্রি
করে দিয়েছে। তোমরা যে চিতার গুহায় আজ রাত্রে থাকবে বলে ঠিক করেছিলে, সেটা এই বাংলোর ছাত থেকে
দেখা যায়। আকাশে মেঘের তেমন উৎপাত না
থাকলে এই চাঁদনি রাতে দেখা যায় ঝর্নাসমেত পুরো উপত্যকাটা।”
গভীর রাতে ছাদে ক্লান্ত
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি
আর জীবন ঘুমাইনি। দুটো নাইট ভিশন বাইনোকুলার নিয়ে আগুন পোয়াতে পোয়াতে শুনছি জ্যোৎস্না-ধোয়া
আকাশে রাতের প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা। ঝর্নার কলতানের সাথে ঝিঁঝিঁর ঐকতান, সংযোজনায় প্রহর জাগা
শিয়াল আর রাত জাগা পেঁচা। দর্শকের অভাবে তাতে বেদনামাখা সুর। কিন্তু এল সেই ডাকে
সাড়া দিয়ে একদল বাদামি ইম্পালা হরিণের দল, ঘাড় নামিয়ে মুখ ডোবায় ঝর্নার
স্ফটিক জলে।
হঠাৎ কেন জানি, এক সতর্ক আওয়াজ আসে তাদের
মধ্যে। নিস্তব্ধ উপত্যকা ছাড়িয়ে সেটা আমাদেরও কানে আসে। মুহূর্তে তাদের বিদ্যুৎবেগে
পালিয়ে যাওয়ার আওয়াজে ঘাসবনে ধূলিঝড় ওঠে। তবে কি... ফিসফিস করে জীবন বলে, “ঝর্নার
দিকে আর গুহার কাছে নজর রাখ, কিছু দেখা যেতে পারে।”
আধঘণ্টা কেটে যায়, বাইনো ধরা হাতদুটো ব্যথা
করে, ঘুম নেমে আসে চোখে। কিন্তু এটা কী? গেস্ট হাউস থেকে ঝর্নাতে
যাবার জন্যে রাস্তায় দেওয়ালে একটা বড়ো গর্ত করা আছে। অবশ্য ওটা একটা বাঁশের গেট
দিয়ে বন্ধ করা আছে। ঠিক সেইদিকের দেওয়ালের ধারে একজোড়া আগুনের ভাঁটামতো জ্বলছে ওটা
কী? ওদিকে অনেক ক’টা গাছ
পাশাপাশি,
চাঁদ এখন
ঠিক ওগুলোর ওপরে থাকায় বেশ অনেকটা ছায়া তৈরি হয়েছে। নাইট ভিশনেও বোঝা যাচ্ছে না।
জীবন ওর নাইট ভিশনকে গলায় ঝুলিয়ে ঢুলছিল। টোকা মারি ওর পিঠে।
ব্যাপারটা চট করে বুঝে
নিয়ে ছাদের সিঁড়ি আর রাস্তায় নামানো কোলাপসিবল শাটারের দিকে তাকিয়ে আমাকে আশ্বস্ত
করে জীবন বলল, “আরও এরকম দুটো বন্ধ গেট
পেরিয়ে তবে জানোয়ারটা এখানে আসতে পারে। ভয় নেই, আমি নিজে বন্ধ করেছি। আমাদের
মধ্যে কেউ যদি ঝর্না থেকে ফেরার পথে গেটটা বন্ধ করতে ভুলে যায় তবেই এই আঙিনাতে ও
ঢুকতে পারবে। আর
শুধু শুধু আঙিনাতে ঢুকবেই বা কেন?”
জীবনের কথা শেষ হতে না
হতেই টিনের শেডে বেঁধে রাখা রবার্টের আনা নধর পাঁঠাটা বোধ করি বিপদ আন্দাজ করে
ব্যা, ব্যা আর্তনাদ করে ডেকে আমাদের
প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিল।
পলক ফেলার কম সময়ে মনে হল
আঙিনাতে একটা ঝড় বয়ে গেল। চাঁদের আলো আর নাইট ভিশন থাকা সত্ত্বেও মনে হল অনেকগুলো
সাদা কালো বিন্দু একসাথে টিনের শেডের দিকে তীব্র বেগে হারিয়ে গেল। পরিষ্কার দেখা
গেল তাকে, তার ফেরার সময়ে। কালো পাঁঠাটাকে মুখে কামড়ে টেনে
নিয়ে যেতে ব্যস্ত সে তখন। এটি খুব সম্ভবত সেই তরুণী চিতাবাঘটি। কী মনে করে সে এক
লহমার জন্যে আঙিনাতে থেমে গেল। সদ্য শিকার করা পাঁঠাটাকে একবার
দেখে নিলে।
কিছু পরে গভীর রাতের
স্তব্ধ উপত্যকায় একবার শোনা গেল বাঘের চাপা হুঙ্কার। নাইট ভিশনে দেখা যাচ্ছিল ঠিক
গুহার কাছে তিন-চারজোড়া ছোটো ছোটো আগুনচোখ। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল আজ বিকালে থুলি
নদীর তীরে দেখা সেই শ্রমিক রমণীটিকে। আমাদের কাছ থেকে পাওয়া আর আমার ইচ্ছে করে
ছেড়ে আসা কাপ নুডলগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে ঘরে রেখে আসা অভুক্ত শিশুদের কথা মনে করতে
করতে অ্যাপ্রনের ভেতর দ্রুত লুকিয়ে নেওয়া সেই খুশি-খুশি মুখ। যেটা দেখিনি তখন,
সেটা এখন পুরো হল। এক ক্লান্ত উপবাসক্লিষ্ট মা বয়ে নিয়ে চলেছে তার পথ চেয়ে থাকা
উপোসী শিশুগুলোর উপাদেয় আহার। সত্যি, মায়েরা সব সমান, তা সে মানুষ হোক আর চিতাবাঘ।
_____
লেখক পেশায় ভূতত্ত্ববিদ এবং
পৃথিবীর বহু দেশে খনিজ অনুসন্ধানের কাজ করেছেন। এই সত্যাশ্রয়ী গল্পটি কিছু সত্য
ঘটনার আংশিক সংমিশ্রণে রচিত কাহিনিমাত্র। বাস্তব কোনও স্থান, কাল, ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্য
কাকতালীয়। সমস্ত আলোকচিত্রগুলি লেখকদ্বারা গৃহীত।
বেশ ভালো লেখা
ReplyDeleteএক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। সত্যি বলছি চাঁদের পাহাড় পড়ার রোমাঞ্চ ফিরে পেলাম
ReplyDelete