
বৈকালিক
ভ্রমণে হাতি
কমলবিকাশ
বন্দ্যোপাধ্যায়
নিয়ম
করে সকালে বা বিকালে ভ্রমণের অভ্যাস কি পশুপাখিদের মধ্যে আছে? অনেক ভেবেচিন্তে
উত্তর দিলেও উত্তরটা সম্ভবত না-ই হবে। খাবারের খোঁজে এরা কখনও কখনও এক জঙ্গল থেকে
আরেক জঙ্গলে যায় ঠিকই, তবে সেটাকে ভ্রমণ
বলা যায় না। পরিযায়ী পাখিদের ক্ষেত্রেও এই একই কথা খাটে। তবে ভ্রমণের এই বিরল
দৃশ্য দেখা যাবে কেনিয়ার সংরক্ষিত সাভানা অঞ্চলে অর্থাৎ, মাউন্ট এলগন ন্যাশনাল
পার্কে গেলে। সেখানকার তৃণভোজী পশুদের মধ্যে বিশেষ করে হাতিদের মধ্যে এই অভ্যাস
আছে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে পেট পুরে খেয়ে বিকেল হতে না হতেই
আফ্রিকার এই হাতিগুলি দলবেঁধে বেড়াতে বের হয়। যায় ‘এলগন’ পাহাড়ের (Mt. Elgon)
দিকে। অন্ধকার হওয়ার আগেই আবার তারা ফিরে আসে। ভাবখানা যেন, ‘পেট পুরে খাওয়া
দাওয়ার পর একটু পায়চারি না করলে কি চলে? হজম হবে না যে!’ এই সাভানা হাতিদের
স্বভাবের সঙ্গে পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার জঙ্গলে যে হাতিদের দেখতে পাওয়া যায় তাদের
স্বভাবের কোনও মিল নেই।
কেনিয়া
ও উগান্ডা পাশাপাশি দুটি দেশের সীমারেখা বরাবর দাঁড়িয়ে আছে ৪,৩২১ মিটার (১৪,১৭৭
ফুট) উঁচু এলগন পাহাড়। এর ১০০ কিলোমিটার উত্তরে আছে ভিক্টোরিয়া হ্রদ। আফ্রিকার
পাহাড়গুলির মধ্যে উচ্চতার বিচারে এটি অষ্টম স্থানে আছে। এই পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা
আছে। গুহাটা অদ্ভুত। প্রতিদিন একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে। হাতির দল নিয়ম করে এই
গুহার মধ্যে যায়, আবার বেরিয়ে আসে। কী আছে ওই গুহায়?
এলগন
পাহাড় প্রকৃতপক্ষে একটা মৃত আগ্নেয়গিরি। বহু বছর আগে যখন জীবন্ত ছিল তখন অগ্ন্যুতপাতের
ফলে কোনও এক সময় এই গুহাটা তৈরি হয়েছিল। সে সময় গুহার আকার অনেক ছোটো ছিল।
প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে বেড়ে বর্তমানে এটা ২০০ মিটারের (৭০০ ফুট) মতো গভীর।
এখনও বেড়ে চলেছে। কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা জানা নেই। এই গুহা দীর্ঘদিন মানুষের চোখের
আড়ালেই ছিল। ১৯৮০ সালে ফ্রান্সের এক পর্যটক প্রথম এই গুহার খোঁজ পান। তবে সেখান
থেকে ফিরে আসার পর মারবুগ ভাইরাসে
(Marburg virus) আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। এরপরে ১৯৮৭
সালে ওই গুহা দেখে ফেরার পর ১৫ বছরের এক ড্যানিশ যুবক ওই একই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে
মারা যান। এই গুহায় অনেক ফলাহারি বাদুরের বাস যাদের থেকে ইবোলা রোগ ছড়ায়।

বেঁচে
থাকার জন্য সকল প্রাণীর দেহে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ নুন থাকা দরকার। শরীরে এই নুন
আসে মূলত খাবারের সঙ্গে। তা না হলে বাইরে থেকে তা জোগাড় করতে হয়। মাংসাশী প্রাণীরা
তাদের প্রয়োজনীয় নুন শিকারের রক্ত ও মাংসের সঙ্গে পেয়ে যায়। অসুবিধায় পড়ে তৃণভোজী
প্রাণীরা। প্রয়োজনীয় নুন ওই ধরনের খাবারে থাকে না। তাই তাদের আলাদা করে নুন খাবার
দরকার হয়।
এলগন
পাহাড়ের গায়ে যে লাভার আস্তরণ আছে তাতে প্রচুর সোডিয়াম যৌগ রয়েছে। গুহার পাশে আছে
একটা ঝর্না। সেই জলে ভিজে ভিজে সেখানকার পাথর তুলনামূলকভাবে নরম। বিশেষজ্ঞদের
অনুমান দীর্ঘদিন ধরেই পশুপাখির দল এখানে জলের খোঁজে আসত। হাতির দলও আসত। কোনও
একদিন জল পান করার সময় কোনও একটি হাতির শুঁড় জলের ভিতর দিয়ে পাথরের গায়ে ঠেকে যায়।
আরে! নোনতা নোনতা লাগছে না? টুক করে পাথরের একটা ছোটো টুকরো ভেঙে নিয়ে মুখে পুরে
দিল। কড়মড় করে চিবোতেই বুঝে গেল এই পাথরে নুন আছে। দ্রুত খবর চলে গেল দলের
অন্যান্য হাতিদের কাছে। তারাও দেওয়াল থেকে পটাপট পাথর ভেঙে মুখে পুরতে লাগল। বাহ্,
নুনের খোঁজে এখানে সেখানে যাবার তো আর দরকার নেই। কাছাকাছি এই গুহায় চলে
এলেই তো হল। অন্যান্য হাতির দলের কাছে এই খবর পৌঁছতে দেরি হল না। এরপর
থেকেই সারাদিনের খাওয়াদাওয়া সেরে হাতির দল নিয়ম করে এই গুহায় আসে। অন্ধকার গুহায়
পাশের দেওয়ালে শুঁড় ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে ভিতরে চলে যায়। তারপর লবণাক্ত দেওয়াল থেকে
পাথরের ছোটো ছোটো টুকরো ভেঙে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে আসে। যেন ভুরিভোজের
পর একটু মুখশুদ্ধি খাওয়া, এই আর কী। দেওয়াল ভাঙার সময় দু’চারটে ছোটো টুকরো নিচে
পড়ে যেতেই পারে। সেগুলি খোঁজার আগ্রহ বা ধৈর্য হাতিদের নেই। তাই গুহার ভিতরে
সেগুলি পড়ে থাকে। অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীরা এখানে জল পান করতে এসে তার দু’চারটি
মুখে তুলে নেয়। তবে তারা হাতিদের মতো নিয়ম করে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে আসে না।
অন্ধকার গুহায় হাতিরা যে দুর্ঘটনায় পড়ে না এমনটা নয়। গুহার ভিতরে ছোটো বড়ো অনেক
ফাটল আছে। মায়েদের সঙ্গে আসা হাতির বাচ্চারা অনেক সময় অন্ধকারে অসাবধানতাবশত ওই
ফাটলে পড়ে গিয়ে মারা যায়।
বছরের
পর বছর এই রুটিন চলে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এইভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ‘মাউন্ট
এলগন কেভ’ বা ‘কিটুম কেভ’ আর গুহা থাকবে না। একটা সুড়ঙ্গ হয়ে যাবে। তখন এটাই হবে পৃথিবীর একমাত্র হাতির
দ্বারা তৈরি সুড়ঙ্গপথ। যদিও এখনই এটা হাতির তৈরি গুহা নামে বিশ্বখ্যাত।

_____
ছবিঃ
আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment