
মিলিন্দাকুঞ্চির
গুহা
পুষ্পেন
মণ্ডল
কাটুম-কুটুম
শব্দটা তোর্সা প্রথম শুনল। কীরকম অদ্ভুত দেখতে জিনিসটা।
একটা গাছের শিকড়। তার মধ্যে বোঝা যাচ্ছে দুটো হাত, দুটো পা, মাথা - একটা মানুষের
আকৃতি। লম্বায় এক হাত। কাঠের পালিশ করা রঙ।
রাঙাদিদা
বলল, “এর নাম ‘টুম্বা’। তোদের দাদু এটা আফ্রিকা থেকে এনেছিলেন।”
“আফ্রিকা!”
“হ্যাঁ,
উনি বিয়ের আগে বছর দশেক আফ্রিকায় একটা বড়ো কন্সট্রাকশন কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার
ছিলেন।”
“তাই
নাকি!” চোখ বড়ো বড়ো করে বলল সে।
“হ্যাঁ,
এটা আমাদের পুরোনো বাড়িতে শো-কেসের মধ্যে অনেকদিন রাখা ছিল। তারপর নতুন বাড়িতে আসার
সময়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল! আর মনে ছিল না এর কথা। এই গত সপ্তাহে আমাদের পুরোনো
বাড়ির ভাড়াটিয়া এসেছিলেন। তিনিই দিয়ে গেলেন।”
রিমা
প্রশ্ন করল, “এতদিন পরে তিনি কোথায় পেলেন এটাকে?”
“আমিও
ঐ একই কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম মানববাবুকে। বললেন, বাড়ির পেছনদিকে জামরুল গাছটা গেল
বর্ষার ঝড়েতে শিকড়সমেত উপড়ে পড়েছে। পরেরদিন সকালে ওনার ছেলে সেখান থেকেই কুড়িয়ে
পেয়েছে। এটার সাথে হয়তো পুরোনো কোনও স্মৃতি
জড়িয়ে আছে, সেই কথা ভেবেই দিয়ে গেছেন।”
একটু
থেমে রাঙাদিদা আবার বললেন, “টুম্বাকে নিয়ে একটা গল্প বলেছিলেন তোদের দাদু।”
“কী
গল্প?”
“বলছি,
তার আগে মিনতিকে আর এক কাপ চা দিতে বল তো। ঠাণ্ডাটা
খুব পড়েছে আজ। আর তোদের জন্য মাছের চপ বানাতে বলেছি। সেগুলো হয়ে গেলে দিয়ে যেতে
বলিস একেবারে।”
সত্যি
কথা বলতে কী, শান্তিনিকেতনে এই দোলের সময়ে কটকটে গরম থাকার কথা। কিন্তু
গত দু’দিনের হঠাৎ বৃষ্টিতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। এসি তো দূরের কথা, রাতে পাখা
চলিয়েও শোয়া যাচ্ছে না। আজ সকালবেলা ক্যাম্পাসে গিয়েছিল সবাই মিলে অনুষ্ঠান দেখতে।
সেখানেই রং খেলা হয়েছে। সারাদিন হুল্লোড়ের পর সন্ধ্যাবেলায় বাচ্চারা জড়ো হয়েছে
রাঙাদিদাকে ঘিরে। তোর্সা দৌড়ে গিয়ে বলে এল চায়ের কথা। ওরা অনেকদিন পর এসেছে শান্তিনিকেতনের
বাড়িতে। এখানে আসলে মজা হয় দেদার। আর উপরি পাওনা হল
রাঙাদিদার মজাদার সব গল্প।
বুলটাই
বলল, “দিদা, আমিও বড়ো হলে আফ্রিকায় যাব হিরের খনি খুঁজতে। চাঁদের পাহাড়ে পড়েছি।”
মুচকি
হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে দিদা শুরু করলেন, “তোর দাদু তখন থাকতেন তানজানিয়ার
‘দার-এস-সালামে’। বাসিলো নামে এক ইটালিয়ান ছেলে কাজ করত তোদের দাদুর সাথে। ওদের
পাশের বাড়িতে থাকত এক ইউরোপিয়ান বাচ্চা, পম। বছর পাঁচেক বয়েস ছিল তার। এই ‘টুম্বা’
ছিল তার খেলার সঙ্গী। সে সবসময়ে একে নিয়ে ঘুরত, সাইকেলে চড়ত, স্কুলে নিয়ে যেত। তার
বাবা ছিল শিকারি। আর পেশায় ব্যবসায়ী। হাতির দাঁত
আর কাঠের ব্যবসা ছিল ডিউক-সাহেবের। এই
কাটুম-কুটুম সংগ্রহের শখ ছিল ওনার। ঘরভর্তি
বিভিন্নরকম ছোটোবড়ো কাটুম-কুটুম। বিভিন্ন আকৃতির পাখি, জন্তু-জানোয়ার, মানুষ।
ডিউক-সাহেব নাকি এই ‘টুম্বা’কে পেয়েছিলেন একটা সিংহের গুহা থেকে।”
বুলটাই
গম্ভীর গলায় বলল, “ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
“হ্যাঁ।
ঘটনাটা আরও কয়েকবছর আগের। ডিউক-সাহেব আর তাঁর এক বন্ধু গিয়েছিলেন সিংহ-শিকারে।
ঘাসের বনে দূর থেকে এক খাদ্যরত সিংহীকে দেখে গুলি করেন। আহত
সিংহীটা পালিয়ে গিয়ে এক গুহার মধ্যে আশ্রয় নেয়। ওরা কাছে গিয়ে দেখে সিংহীটার
পাঁচটা ছোটো ছোটো বাচ্চা। ওদের মনে খুব অনুশোচনা হয়। তখন সিংহীটার পিছু ধাওয়া না
করে তারা ফিরে আসে। দু’দিন পর তারা আবার যায় সেই জায়গায়। দেখে পাঁচটা বাচ্চাই মারা
গেছে। বুনো জন্তুরা এসে খেয়ে গেছে তাদের। তারপর ওরা খুঁজতে খুঁজতে সেই গুহায় গিয়ে
ঢোকে। সেখানে মরে পড়েছিল সিংহীটি। তার পাশ থেকেই খুঁজে
পান এই ‘টুম্বা’কে। এরপরে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল।”
রাঙাদিদা
আবার চায়ে চুমুক দিলেন। মাছের গরম গরম চপও এসে গেছে ততক্ষণে। সবাই হাত বাড়িয়ে তুলে
নিল একটা করে। রিমা একটা কামড় বসিয়ে প্রশ্ন করল, “কী ঘটেছিল?”
“ঐ
ঘটনার পর তখন কেটে গেছে অনেকদিন। ডিউক-সাহেব তোর দাদুকে বললেন, চল জয়ন্ত, অনেকদিন
শিকারে যাওয়া হয়নি। সামনে ক’দিন ছুটি আছে। শহর
থেকে একশো কিলোমিটার দূরে ‘মিকুমি’ অরণ্যভূমি হরিণ-শিকারের আদর্শ স্থান। সেইমতো,
জয়ন্ত, বাসিলো আর ডিউক-সাহেব বেরিয়ে পড়লেন একটা জীপে করে।
“সেইদিনই
সকালে পম হঠাৎ বলেছিল, বাবা আজকে তোমরা শিকারে যেও না। এইমাত্র
টুম্বা নাকি তাকে বলছে, তাদের তিনজনের মধ্যে একজন আজকে সিংহের পেটে যাবে। শুনে
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বাচ্চাছেলের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি সেদিন। কিন্তু কথাটা
সত্যি হয়ে গেল।
ধু
ধু লম্বা লম্বা ঘাসের মাঠ। তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকত হরিণের দল, আর আফ্রিকার ভয়ংকরতম
সিংহ। হরিণের পেছনে ধাওয়া করতে করতে অনেকদূর চলে গিয়েছিল ওরা। পাথুরে জমি। আচমকা
জীপের সামনের একটা চাকা ফেটে গেল। স্টেপনি পালটাচ্ছিলেন
ডিউক-সাহেব। তোর দাদু আর বাসিলো রাইফেল নিয়ে
পাহারা দিচ্ছিলেন। সেই সময়ে একদল হরিণ কাছাকাছি চলে আসে। বাসিলো ধাওয়া করে তাদের
পেছনে। জয়ন্ত যদিও একা যেতে বারণ করেছিল তাকে। কিন্তু সে কথা শোনেনি। হরিণের পেছনে
ছুটল সে। বড়ো বড়ো ঘাসের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছিল অনেকটা। তার
মিনিট পনেরো পর দুটো রাইফেলের আওয়াজ হল। শোনা গেল
একটা চিৎকার। তখন ডিউক-সাহেবকে একা রেখে জয়ন্ত বাসিলোর পেছনে দৌড়ালেন। গিয়ে
দেখেন একটা মৃত হরিণের পাশে বসে আছে সে। বলল, গুলি
করার পর শিকারের পেছনে ছুটতে গিয়ে পাথরে ঠোক্কর খেয়ে পা মচকে গেছে। তখনই চেঁচিয়ে
উঠেছিল। তারপর টেনে হিঁচড়ে দু’জনে মিলে হরিণটাকে গাড়ির কাছে যখন নিয়ে আসে, তখন
ডিউক-সাহেবকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
তোর্সা
গোল গোল চোখে প্রশ্ন করল, “কোথায় গেল ডিউক-সাহেব?”
“সম্ভবত
সিংহের পেটে। সারাদিন ধরে ওরা অনেক খুঁজল জঙ্গলে। যতদূর যাওয়া সম্ভব গেল। কিন্তু
ডিউক-সাহেবের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। পরেরদিন জয়ন্ত ফিরে এসে পমকে জিজ্ঞেস
করতে সে জানায়, টুম্বা সত্যিই তার সাথে কথা বলে। সে অনেককিছু জানে। টুম্বা তাকে
বলেছে, সে নাকি এক অন্য সভ্যতার প্রাণী। তাদের রাজা এক বিশেষ কাজে তাকে এখানে
পাঠিয়েছে।”
“অন্য
সভ্যতার প্রাণী!”
“হ্যাঁ,
কিন্তু একটা কাঠের টুকরো কীভাবে তার সাথে কথা বলতে পারে! ব্যাপারটা খুবই
অস্বাভাবিক। জয়ন্তর মনে হয়েছিল বাচ্চা ছেলেটির মাথায় হয়তো গণ্ডগোল আছে। বেশ কিছুদিন
কেটে যেতে কথাটা মুছে গেল মাথা থেকে।
কয়েকমাস
তখন কেটে গেছে। একদিন সকালে জয়ন্ত গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে। দক্ষিণের বন্দর শহর
‘সোমাঙ্গা’ যাবে কোম্পানির কাজে। পম কোথা থেকে সাঁ করে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে।
হাউ হাউ করে কাঁদছে আর বলছে, আমাদেরকে বাঁচাও। কী ব্যাপার? টুম্বা নাকি তার উপর
খুব রাগ করেছে। আজকে তাকে বলেছিল পাহাড়ের গুহায় গিয়ে রেখে আসতে। কিন্তু ও কার সাথে
যাবে সেখানে? জয়ন্তকে অনেক করে অনুরোধ করল নিয়ে যেতে।
কিন্তু নিজের কাজ ফেলে ও যেতে রাজি হয়নি। সে যথারীতি চলে গেল সোমাঙ্গা। আশ্চর্যের
ব্যাপার, সেইদিনই সন্ধ্যার পরে একটা বিধ্বংসী সাইক্লোন আছড়ে পড়ল দার-এস-সালামে। তাতে
শহরের অনেক বাড়ি তছনছ হয়ে গেল। ডিউক পরিবারের সবাই বাড়ি চাপা পড়ে মারা গেল।”
“সেকি!”
“ঘটনাটা
কাকতালীয় ছিল হয়তো। জয়ন্ত খবরটা শুনে খুব ভেঙে পড়েছিল।
পরেরদিন সোমাঙ্গা থেকে ফিরে জয়ন্ত ভাঙা বাড়ির নীচ থেকে উদ্ধার করল টুম্বাকে। পমের
হাতে শেষপর্যন্ত ধরা ছিল এটা।”
“তারপর?”
“এরপর
জয়ন্ত বেশ কিছুদিন ধরে নিজের মনে সারাদিন বিড়বিড় করে কথা বলত পাগলের মতো।
কাজকম্ম তখন শিকেয় উঠেছে। কখনও দূরে পাহাড়ের মাথায় গিয়ে বসে থাকত একা। ধীরে
ধীরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হল। ছ’মাস পরে যখন দেশে ফিরল জাহাজে করে তখন এত্তো বড়ো
বড়ো দাড়িগোঁফের জঙ্গল। পাগলের মতো চেহারা। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হয়েছিল বহুদিন। ধীরে
ধীরে স্বাভাবিক হয়েছিল পরে। ঐ মাঝের সময়ে কী ঘটেছিল, তা আর মনে নেই। বাসিলোর আর
কোনও খোঁজও পাওয়া যায়নি। শুধু জয়ন্তর লাগেজের মধ্যে এই কাটুম-কুটুমের সাথে একটা
ডায়েরি পেয়েছিলাম। সেটা বাসিলোর লেখা। ইটালিয়ান ভাষায় সে কিছুটা বর্ণনা দিয়ে
গিয়েছিল কী ঘটেছিল ওর আর জয়ন্তর সাথে। আফ্রিকার আদিম অন্ধকারাচ্ছন্ন পাতালপুরী
মিলিন্দাকুঞ্চির গুহায় ঢুকেছিল দু’জনে। কিন্তু জয়ন্ত মনে হয় একাই বেরিয়েছিল সেখান
থেকে। তাকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি সে কথা। তবে কোনও উত্তর দিতে পারেনি। যতটুকু জানা
যায় সবই সেই ডায়েরি থেকে।”
বুলটাই
জানতে চাইল, “কোথায় সে ডায়েরিটা এখন?”
“সেটা
তো কবেই উইয়ে খেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে আমি ইটালি থেকে বাংলা অনুবাদ করে রেখেছিলাম
একটা খাতায়। যদি বলিস সেটা পড়ে শোনাতে পারি। ঐ বুক-শেলফের কোণে রাখা আছে নীল রঙের
খাতাটা। নিয়ে আয়।”
বুলটাই
দৌড়ে গিয়ে খাতাটা নিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “দিদা, তুমি ইটালি ভাষা শিখলে কবে?”
“সেই
ডায়েরিটা পড়ার জন্যই শিখতে হল। এমন কিছু কঠিন নয়। ‘ইংলিশ টু ইটালিয়ান’ একটা
ডিকশনারি কিনে নিলাম।”
বাইরে
তখন ভরা দোলপূর্ণিমার গোল বড়ো চাঁদ উঠেছে। রূপালি জোৎস্নায় ভরে যাচ্ছে পলাশফুলের
দেশ। দূর থেকে ভেসে আসছে ক্যাম্পাসের গানবাজনার আওয়াজ। রাঙাদিদা বাসিলোর ডায়েরিটা
পড়তে শুরু করলেন।
১৫ই
এপ্রিল, মিকুমি অরণ্য, তানজানিয়া
এখন
বসে আছি মিলিন্দাকুঞ্চির গুহায়। হঠাৎ করে এখানে এসে পড়েছি জয়ন্তর পাল্লায় পড়ে। দার-এস-সালাম
থেকে মিকুমি অরণ্য অঞ্চল সরাসরি একশো কিলোমিটার পশ্চিমে। সেখানে ‘উলুগুরু’ পাহাড়ের
মাঝামাঝি একটা বিশাল বড়ো গুহা আছে। তার ভেতর
দিয়ে একটা গুপ্তপথ নেমেছে এখানে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মিলিন্দাকুঞ্চি নামটা
জয়ন্তই আমাকে বলেছিল। ক’দিন হল ও
একটা ভূতুড়ে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে। কেমন যেন পাগলের মতো দশা। সবসময়ে চোখেমুখে একটা
আতঙ্ক। ব্যাপারটা খুলে বলি প্রথম থেকে।
একদিন
আগে রাতের ঘটনা। জয়ন্ত মাঝরাতে দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে বলল, “আমার সাথে
বেরোতে হবে।”
জিজ্ঞেস
করলাম, “কোথায়?”
“সিংহের
গুহায় যাব। সেখানেই রাস্তা পাওয়া যাবে।”
“রাস্তা!
কোথায় যাওয়ার রাস্তা?”
“মিলিন্দাকুঞ্চি
যাওয়ার রাস্তা।”
“সেটা
আবার কী?”
“মাটির
নীচে। টুম্বা আমাদেরকে নিয়ে যাবে সেখানে। আমাদের সবার খুব বিপদ, বুঝলে!”
“কীসব
বলছ তুমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি ভেতরে এসে বস। আমি বরং ডাক্তারকে কল
দিই।”
সে
চোখ লাল করে বলল, “শোন বাসিলো, তুমি আমার অনেকদিনের বন্ধু, তাই বলছি। নইলে আমি তো
তৈরি হয়েই বেরিয়েছি। তুমি না গেলে আমি একাই যাব।”
জয়ন্তর
মাথায় কিছু চাপলে সেটা সহজে নামে না। খুব একগুঁয়ে আর জেদি। আমি ঘণ্টাখানেক ধরে
অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু
কিছুতেই কিছু হবার নয়। শেষে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জয়ন্তর সাথে।
আমাকে সঙ্গে নেওয়ার অবশ্য আর একটি কারণ আছে। আমি হলাম এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট। আর
এর আগে বেশ কয়েকটা গুহা অভিযানের অভিজ্ঞতা আছে আমার।
জীপে
করে বেরোলাম সেই রাতেই। শহর থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে ঘন জঙ্গল পেরিয়ে
পাহাড়ের কোলে সেই গুহা। অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল ছিল। তার উপর আছে সিংহের
ভয়। যদিও দু’জনের কাছেই শক্তিশালী রাইফেল আছে।
আসতে
আসতে ওর মুখে শুনলাম গল্পটা। গল্পই মনে হল। কারণ, এখনও এটাকে সত্যি বলে মেনে নিতে
মন চাইছে না। জয়ন্ত যা বলল সেটা হল, এই পাহাড়ের নীচে আছে বহু লক্ষ বছরের পুরনো আর
এক সভ্যতা। তাদের নাম ‘হুগুরা’, একধরনের বামন প্রজাতির মানুষ। পৃথিবীর উপরতলার
মানুষের অগ্রগতি হয়েছে বিজ্ঞানের যুক্তি আর নিয়মের মধ্যে দিয়ে, ওদের বেলায় সেটা
উলটো। হুগুরাদের সবকিছুই মন্ত্রতন্ত্র, কালা জাদু, ডাকিনি বিদ্যা, অপরসায়ন এইসবের
উপর ভিত্তি করে। মানে সোজা কথায় যেটা আমাদের কাছে অন্ধ কুসংস্কার, সেটাই ওদের কাছে
জীবনের মূল ভিত্তি। ওদের বর্তমান রাজা পুকান্দাকু কালাজাদুর মাধ্যমে পাতালপুরীর
সমস্ত রাজ্য নিজের দখলে নিয়েছেন। এবার কালাজাদুর মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে পুকান্দাকু
নিজের দাস বানাতে চায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিয়ে মনুষ্য সভ্যতাকে পেছনদিকে
নিয়ে যাওয়াই তার লক্ষ্য। সমস্ত পরিকল্পনা তার তৈরি হয়ে গেছে।
কয়েকদিনের মধ্যে ওরা মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এক একটা শহর দখল করে নেবে।
আমার
মতে এই গাঁজাখুরি কথাগুলো বিশ্বাস করার কোনও যুক্তি নেই। আমি এসেছি শুধু
বন্ধুত্বের খাতিরে। যেভাবেই হোক জয়ন্তর মাথা থেকে এই হুগুরাদের ভূত আমি নামাব।
জিজ্ঞেস করলাম, “এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?”
“যে
কোনওভাবে পুকান্দাকুকে আটকাতেই হবে। তোমাকে যেমন বলেছিলাম, ডিনামাইটের স্টিকগুলো
নিয়েছ তো সঙ্গে?”
আমি
মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম, নিয়েছি। যাই হোক, পাহাড়ের সানুদেশে গাড়ি রেখে ভোররাতে পাহাড়ের
গা বেয়ে উঠতে শুরু করলাম দু’জনে। এলাকাটা সিংহের গড় বলে পরিচিত। এর আগেও আমরা এদের
খপ্পরে পড়েছিলাম একবার। ডিউক-সাহেবকে হারিয়েছি। তাই আগে থেকেই সতর্ক ছিলাম। ছোটো বড়ো
পাথরের খাঁজের পাশ দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ফুট ওঠার পর আচমকা টের পেলাম একদল সিংহ
আমাদের পিছু নিয়েছে। তখন জমাট অন্ধকার চারপাশে। নিজেদের পায়ে চলার শব্দ ছাড়া আর
কিছু কানে আসছে না। চাপা স্বরে জয়ন্তকে সাবধান করলাম। ও
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “টুম্বা আছে আমাদের সাথে। ওরা কিচ্ছু করবে না।”
এতটা
আত্মবিশ্বাসের কোনও কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। বললাম, “তবু রাইফেলটা হাতে রেডি
রাখ। ঘাড়ের উপর এসে পড়লে তো আর রক্ষে নেই।”
খেয়াল
করে দেখলাম দু’পাশেই বেশ দূরত্ব রেখে চারপেয়েগুলো এগোচ্ছে আমাদের লক্ষ্য করে।
কমবেশি কুড়ি-পঁচিশটা হবে। বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। সামনে একটা বড়ো বাওয়াবগাছ। ঝাঁকড়া
ডালের উপর একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল। মনে হল, ওর উপরে উঠে ওত পেতে রয়েছে ওরা। নিচ দিয়ে
যেতে গেলেই ঘাড়ের উপর পড়বে ঝাঁপিয়ে। তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে ঘাড়ের সুষমাকাণ্ডে একটা
কামড় বসাতে পারলেই ভবলীলা সাঙ্গ। কিন্তু অবাক ব্যাপার, এত কাছে পেয়েও কেউ আমাদের
আক্রমণ তো দূরের কথা, টুঁ শব্দ পর্যন্ত করল না একবারও। আশ্চর্য!
গুহার
মুখে যখন পৌঁছালাম, সূর্যের আলো ফুটেছে পূর্বদিকে। ভেতরে
একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ। বুনো জন্তুর হাড়গোড় পড়ে রয়েছে ভেতরে। নিশ্চিত এরা সব
সিংহের শিকার। গুহাটা বেশ বড়ো। ছাদটা
পেছনদিকে ক্রমশ নিচু হয়ে ঢুকে গেছে ভেতরে। জয়ন্ত টুম্বাকে একটা পাথরের উপরে বসিয়ে বিড়বিড়
করে কিছু বলতে লাগল। দেখালাম, টুম্বার শরীরে হালকা নড়াচড়া শুরু হয়েছে। সেও যেন
কিছু বলছে। ব্যাপারটা চোখের ভুলও হতে পারে। কিছুক্ষণ পর জয়ন্ত টুম্বাকে পিঠের
ব্যাগে চালান করে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল গুহার ভেতর দিকে। আমাকেও ওর পেছনে যেতে বলল ইশারায়। আমি
বিনা বাক্যব্যয়ে ওর নির্দেশ পালন করলাম। দিনের আলো সেখানে প্রবেশ করে না। যত ভেতরে
ঢুকছি তত বাড়ছে অন্ধকার। শেষে নিচে আর উপরের পাথর এত কাছাকাছি চলে এল যে আর এগোনো
সম্ভব নয়।
জিজ্ঞেস
করলাম, “এবার কোথায় যাব?”
জয়ন্ত
জানাল, “টুম্বা বলছে এই খাঁজের মধ্যেই একটা পথ আছে নিচে যাবার। সেটাই
খুঁজে বের করতে হবে প্রথমে, বুঝলে? মিলিন্দাকুঞ্চি যাওয়ার রাস্তা ওখানেই পাওয়া
যাবে।”
“সে
তো বুঝলাম, কিন্তু টর্চের আলোয় যতদূর দেখা যাচ্ছে, এই খাঁজের তো কোনও শেষ নেই!”
“তুমি
ডানদিকটা দেখ। আমি বাঁদিকে খুঁজছি। যে আগে খুঁজে পাবে অন্যজনকে জানিয়ে দেব চিৎকার
করে।”
সেইমতো
হামাগুড়ি দিয়ে দু’জন দু’দিকে চলে গেলাম। বাইরে থেকে
গুহাটাকে দেখলে ভেতরটা যে এত বড়ো সেটা বোঝা যায় না। আমার দিকে গুহার খাঁজটা ধীরে
ধীরে উপরের দিকে উঠেছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে ডানদিকের সেই খাঁজটা শেষ হল। এরপর আর
রাস্তা নেই এগোনোর। উপর নিচে পাথর এমনভাবে এঁটে গেছে যে পথ পাবার সব আশা শেষ।
এদিকে জয়ন্তর দিক থেকে এখনও কোনও সাড়াশব্দ আসেনি। তার মানে কি ওদিকেও কোনও রাস্তা
পাওয়া যায়নি! আমি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার? রাস্তা পেলে?”
কোনও
প্রত্যুত্তর এল না। এরকম অজানা জায়গায়, অপ্রাকৃতিক জিনিস নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা
খুবই বিপদজনক হতে পারে। আফ্রিকায় কালাজাদুর চল বহু শতাব্দীর পুরনো।
এরা বংশপরম্পরায় এসব জিনিস শেখে। হয়তো এসবের পেছনে সত্যিই কোনও অন্ধকার সভ্যতা
লুকিয়ে আছে। আদিবাসীদের মধ্যেও অনেকরকম পুতুল থাকে, যারা নাকি কথা বলে, অনেকের
ভবিষ্যৎও বলে দেয় এরা। এতদিন এসব বিশ্বাস করিনি আমি। কিন্তু
এখানে এসে মনের মধ্যে কীরকম একটা ভয় ভয় করছে।
যাই
হোক, যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই ফিরে চললাম পেছনদিকে। চারদিক নিস্তব্ধ। তবে গুহার
পেটের মধ্যে অনেক সময়েই বিষধর সাপেরা বাসা করে থাকে। আর তারা এইরকম নিরিবিলি পাথরের
খাঁজই পছন্দ করে বেশি। সেদিক থেকে রীতিমতো সাবধানে থাকতে হচ্ছে। একবার ভুলক্রমেও
ওদের সংস্পর্শে এলে আর রক্ষা নেই। ভাবতে ভাবতেই কানে এল একটা অদ্ভুত কিরকির করে
আওয়াজ। যেন অন্ধকারে বসে কেউ ঝুনঝুনি বাজাচ্ছে। শব্দটা লক্ষ করে টর্চ ফেলতে যা
দেখলাম তাতে রক্ত হিম হয়ে যাবে। আফ্রিকার বিখ্যাত র্যাটেল স্নেক। একটা
সরু খাঁজের মধ্যে ঢুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে কিরকির করে
বাজতে শুরু করেছে ওর লেজের শেষপ্রান্ত। কিছুক্ষণ আগেই ওর পাশ দিয়ে এসেছি। তার
মানে মৃত্যু বেরিয়ে গেছে কান ঘেঁষে।
আরও
সাবধান হয়ে এগোতে থাকলাম। যে জায়গাটা থেকে দু’জন দু’দিকে গিয়েছিলাম, সেখানে পাথরের
গায়ে একটা দাগ দিয়ে রেখেছিলাম আগে থেকেই। সেই দাগের কাছে পৌঁছে আমি আবার চিৎকার
করলাম, “জয়ন্ত... জয়ন্ত...”
কিন্তু
এবারেও কোনও সাড়া নেই। কোথায় গেল! কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সামনের দিকেই চললাম। খাঁজটা
আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছে। খেয়াল হল এদিকের পাথরটা একটু ভিজে। আর স্যাঁতস্যাঁতে।
আরও কিছুটা এগোতে হাতের জলের স্পর্শ পেলাম। পাথরের উপর
দিয়ে জলের একটা স্রোত চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে উপর থেকে। কিছুক্ষণ করে এগোই, আবার একটু
করে থামি। জয়ন্তর নাম ধরে ডাকছিলাম বার বার। কিন্তু কোনও ফল হচ্ছিল না। বুকের
মধ্যে একটা হতাশা আর আতঙ্ক চেপে বসছিল ধীরে ধীরে। ঘণ্টা তিনেক এভাবেই এগোনোর পর
সামনে দেখতে পেলাম প্রায় কুড়ি ফুট বাই দশ ফুট একটা প্রাকৃতিক চৌবাচ্চা। পাথরের গা দিয়ে
জল চুঁইয়ে এসে জমা হচ্ছে সেখানে। সেটাকে পাশ কাটিয়ে আরও পঞ্চাশ ফুট মতো গিয়ে গুহার
খাঁজটা শেষ হল।
তার
মানে আদৌ ভেতরে ঢোকার যদি কোনও রাস্তা থাকে, তাহলে সেটা এই চৌবাচ্চার মধ্যে দিয়েই
আছে। আর একটা যুক্তি হল, জয়ন্তকে এতবার ধরে ডাকা সত্ত্বেও সে কোনও সাড়া দিল না।
তার মানে, সে হয়তো এই জলের নিচেই নেমেছে। আমিও জামাকাপড় খুলে নেমে পড়লাম। জলটা বেশ
ঠাণ্ডা। আমার টর্চটা ওয়াটার প্রুফ। তাই জলের নিচেও স্বচ্ছন্দে দেখা যাচ্ছে। চৌবাচ্চাটার
গভীরতা আনুমানিক তিরিশ ফুট হবে। একবার করে দম বন্ধ করছি, ডুবসাঁতার দিয়ে নেমে যাচ্ছি
নিচে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে চেষ্টা করার পরে একটা রাস্তা দেখতে পেলাম। পনের ফুট নিচে
একটা সরু গোলাকৃতি পথ ঢুকে গেছে। কোনওরকমে হয়তো গলে ঢোকা যাবে সেখান দিয়ে। কিন্তু বেরনো
যাবে না আর। ভেতরে ঢুকে গেলে কতক্ষণ দম চেপে
রাখতে পারব সেটাই চিন্তার। অবশ্য অন্য উপায়ও আছে।
এর
আগে থাইল্যাণ্ডের ‘পাং নাগা’ সমুদ্রে জলের নিচে একটা ডুবন্ত ডলোমাইটের গুহায়
নেমেছিলাম। আর একবার ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্রুজ আইল্যান্ডের জলে নিমজ্জিত গুহার
ভেতরে আটকে পড়েছিলাম তিনদিন। তাই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাগ থেকে ছোটো অক্সিজেন
সিলিন্ডারটা বের করে হাতে রাখলাম। আপদকালীন দরকারে কাজে আসবে এটা। আর
একটা বড়ো প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ বের করে জামাকাপড়সমেত সবকিছু সেটার মধ্যে ঢুকিয়ে
দিলাম। মুখটা ভালো করে বেঁধে নেমে গেলাম জলের মধ্যে। এতে অন্য জিনিসপত্র জলে ভেজার
সম্ভাবনা কম।
জলের
মধ্যে সেই সরু গুহার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করতে শরীরের মধ্যে যেন একটা শিরশিরানি
অনুভব করলাম। হালকা ইলেকট্রিকের শক লাগলে যেমন হয়, অনেকটা সেইরকম। মাটির নিচে অনেক
সময়ে তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়ে থাকে প্রাকৃতিক উপায়ে। এটা সেই কারণেও হতে
পারে। যাই হোক, বেশ কিছুটা যাবার পর যখন দম শেষ হয়ে গেল তখন অক্সিজেন সিলিন্ডারের
সাহায্য নিতেই হল।
মাঝখানে
একটা ইউ আকৃতির বাঁক আছে। সেখানে একবার শুধু আটকে গিয়েছিল
ব্যাগটা। টেনেটুনে ছাড়িয়ে আবার এগোলাম। একটা কথা ভাবছি, আমার কাছে না হয়
অক্সিজেনের সিলিন্ডার আছে, কিন্তু জয়ন্ত এই রাস্তায় গেল কী করে?
গুহাটা
শেষ হল যেখানে, মুখ বাড়িয়ে দেখি পুরো অন্ধকার। টর্চের আলো যত দূর যাচ্ছে ডলোমাইটের
সূচালো দেয়াল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। জায়গাটা চওড়ায় তিরিশ ফুট আর উচ্চতায় ষাট
ফুটের মতো হবে। উপর থেকে নেমে এসেছে লম্বা লম্বা সূচালো ফলা। আলো পরে চকচক করছে সেগুলো।
তবে শুকনো মেঝেতে আলো পড়তে লক্ষ করলাম, একটা জলের রেখা। মনে হচ্ছে ভারী কিছু জল
থেকে তুলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এখান দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে। আর
সেটা যে জয়ন্তকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিশ্চিত হলাম আরও একটু এগিয়ে। ওর গলায় একটা নীল
রঙের রুমাল জড়ানো ছিল। সেটা খুলে পড়ে রয়েছে এখানে। কে বা কারা ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে
এই পথে। তবে কি সেই হুগুরাদের গল্পটাই সত্যি! কে জানে!
বেশ
কিছু দূর পর্যন্ত সেই জলের রেখা লক্ষ করে এগোলাম। তারপর ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে এল
নিশানা। এতদূর যেহেতু রাস্তাটা সরলরেখা বরাবরই এসেছে, বাকি পথটাও সেভাবেই যাবে আশা
করি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর গুহাটা ফাঁকা জায়গায় এসে শেষ হল। জোরালো টর্চের
আলোও ও-প্রান্তে পৌঁছচ্ছে না। স্থানটা এত
বড়ো। এবড়োখেবড়ো পাথরে ভর্তি। মাঝে মাঝে
ঠাণ্ডা জলের সরু রেখা বয়ে চলেছে কুলকুল করে। ঘড়ি দেখে হিসাব করলাম, প্রায় একটা দিন
অতিক্রান্ত হয়েছে এই গুহায় ঢোকার পর। খিদেতে পেট কামড়াচ্ছে। অতএব একটু বিশ্রাম
নেওয়াই ভাল।
একটা
বড়ো পাথর দেখে উঠে বসলাম তার উপর। আগে কিছু খেয়ে নিলাম। তারপর ব্যাগের উপর মাথা
রেখে শুয়ে পড়লাম টানটান হয়ে। শরীরের উপর ধকল গত একদিনে কম যায়নি।
এখন ব্যাটারির আলো জ্বেলে ডায়েরি লিখতে লিখতে ভাবছি, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
১৮ই
এপ্রিল, মিলিন্দাকুঞ্চির গুহা
গত
দু’দিনে একটা ঝড় বয়ে গেল। ডায়েরি লেখার সুযোগ পাইনি এক ফোঁটা। ঘটনাগুলোর বিভীষিকা
কাটতে সময় লাগবে। এখনও কাঁপছে হাত থরথর করে। জানি না এই পাতালপুরী থেকে বেরোতে
পারব কি না কোনওদিন।
সেদিন
ডায়েরি লেখা শেষ করে ব্যাগে পুরে দিলাম খাতাটা। তারপর পাথরের উপরে শরীরটা লম্বা
করে চোখ বুজতেই অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল স্থানটা। গন্ধের উৎসটা কিছুতেই খুঁজে
পেলাম না। ক্লান্তি তো ছিলই, হঠাৎ করে একটা গভীর ঘুম যেন গ্রাস করল। পরে মনে হল
হয়তো ঐ গন্ধের মধ্যেই ক্লোরোফর্ম জাতীয় কিছু ছিল।
চোখ খোলার চেষ্টা করেও পারছিলাম না। বিদঘুটে স্বপ্নরা সব ভিড় করে আসছে মাথার
মধ্যে।
একবার
যেন দেখলাম ঘূর্ণিঝড়ের মতো একটা সাদা ধোঁয়া পাক খেতে খেতে এসে চাগিয়ে নিয়ে চলল
আমাকে। আর একবার মনে হল, আমাকে একদল কালো কালো বামনশ্রেণীর মানুষ বয়ে নিয়ে চলেছে। সুদীর্ঘ
একটা গুহা। ক্রমশ নেমে যাচ্ছি মাটির নিচে। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই।
কোনটা যে বাস্তব, আর কোনটা নয় চিন্তার জাল ছিঁড়ে সেটাকে আলাদা করতে পারছিলাম না।
যাই
হোক, সেই ঘুমের ঘোর যখন আস্তে আস্তে কাটল, দেখি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি অন্য স্থানে।
উপরের আকাশটা ‘অ্যানিমন’ ফুলের মতো টকটকে। একটা অদ্ভুত মায়াবী নরম রক্তিম আলো
ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অনেক চেষ্টা করেও হাত পা নাড়াতে পারলাম না একচুল। কেউ যেন আঠা
দিয়ে এঁটে দিয়েছে মেঝের সাথে। অজানা কোনও কারণে গলা দিয়েও শব্দ বের হচ্ছে না এক
ফোঁটা। ঘাড় আর চোখদুটো শুধু খোলা রয়েছে। কানে আসছে একঘেয়ে একটা শব্দ। দ্রিম দ্রিম...
দ্রিম দ্রিম... একটানা। কোথা থেকে আসছে বুঝতে পারছি না।
একটা
ধুপ ধুপ শব্দ কানে আসতে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানদিকে দেখলাম একটা একহাত লম্বা বামন মানুষ
এগিয়ে এল আমার দিকে। শরীরের তুলনায় মাথাটা বেশ বড়ো, গোলমতো।
চুল নেই একটুও। গায়ের রং কুচকুচে কালো। কানগুলো বেশ লম্বা। আমার মুখের সামনে এসে
অদ্ভুত ভাষায় কিছু একটা বলল। আমি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু
তাকিয়ে থাকলাম হাঁ করে।
এবার
সে অঙ্গভঙ্গি করে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করল। তাতেও খুব একটা লাভ হল না। আমি শুধু
মাথাটা সামান্য নাড়ালাম। সে কী বুঝল কে জানে।
একটা পাত্র থেকে ঘন তরল পদার্থ আমার গায়ের উপর ঢেলে দিল। একটা
বেশ গরম লাগল। তারপর খেয়াল করলাম, হাত পাগুলো আস্তে আস্তে পাথর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। ধীরে
ধীরে সোজা হয়ে উঠে বসলাম। চোখ গেল চারপাশে। চমকে উঠলাম!
কয়েক শো বামন মানে হুগুরা দাঁড়িয়ে আছে আমাকে ঘিরে। প্রত্যেকের
হাতে বর্শার মতো একটা করে লম্বা ফলা লাগানো অস্ত্র। সারা গায়ে আঁকিবুঁকি। গোল গোল
চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সামনের বামনটা আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখল কিছুক্ষণ। আমি
সোজা হয়ে বসে দেখলাম, মাটি থেকে আমার বুকের কাছে ওর মাথা।
সে
এগিয়ে এসে আমার পায়ের আঙুল থেকে শুরু করে হাতের আঙুল, মাথার চুল সব পরীক্ষা করল।
শেষে মাথা নাড়তে নাড়তে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হুগুরাদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলল নিজেদের
ভাষায়। তারা দেখলাম কথাটা শুনেই তিড়িংবিড়িং
করে লাফাতে শুরু করল আনন্দে। বুঝলাম সামনেরটা হচ্ছে পালের গোদা। সে আমার দিকে ফিরে
এগিয়ে এসে একটা সরু দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল হাতের কবজিদুটো। বাধা দিয়ে লাভ নেই।
সংখ্যায় এরা অনেক। এরপর ইশারায় দাঁড়াতে বলল আমাকে। আমি আদেশ পালন করলাম। তারপর
তারা লাইন দিয়ে যাত্রা শুরু করল। বন্দি অবস্থায় আমিও এগোলাম তাদের সাথে। অর্ধেক
আমার সামনে আর বাকিরা পেছন পেছন চলল।
ছোটবেলায়
লিলিপুটদের দেশের অনেক কাহিনি পড়েছি। সত্যিই যে
সেরকম কোনও দেশ আছে, দেখে অবাক হলাম বেশ। তবে আফ্রিকার কঙ্গো প্রদেশে পিগমি আর
বান্টু নামে দু’ধরনের বামন প্রজাতির উপজাতি বাস করে এখনও। তারা
হয়তো এদেরই উত্তরসূরি। কিন্তু জয়ন্ত গেল কোথায়? তার তো
টিকিও দেখতে পাচ্ছি না!
বেশ
কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখি রাস্তার দু’পাশে ছোটো ছোটো গাছ। তাতে কুলের মতো কীসব ফল
হয়ে আছে কালো কালো। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চাষ হয়েছে। মনে হয় এটাই এদের প্রধান
খাদ্য।
দূর
থেকে একটা জোরালো লাল আলো চোখে পড়ছিল। সেই দ্রিম
দ্রিম আওয়াজটা জোর হচ্ছে ক্রমশ। সেদিকেই আমাকে মনে হয় নিয়ে যাচ্ছে এরা। কাছে গিয়ে
দেখলাম একটা গোল কুয়ার মধ্যে থেকে লাল আলোর স্তম্ভ উঠেছে। আলোটা অনেক উপরে ছাদে
লেগে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। আলোর স্তম্ভটা ঘিরে ছোটো ছোটো ড্রামের মতো একধরনের বাজনা
বাজাচ্ছে হাজারখানেক হুগুরা। সেগুলো
থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে দ্রিম... দ্রিম... দ্রিম...
চোখে
পড়ল জয়ন্তকে। সে মাথা নিচু করে হাঁটু মুড়ে বসে আছে সামনে। কোনও নড়াচড়া নেই।
শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে কি না সেটাও বুঝতে পারছি না দূর থেকে। তার সামনে একটা উঁচু
পাথরের সিংহাসনে এক অদ্ভুত বামনকে দেখতে পেলাম। তার গোটা পিঠে রঙবেরঙের লম্বা
লম্বা রঙিন পালক লাগানো। গায়ে সাদা রং দিয়ে কিম্ভূত আঁকিবুঁকি
করা। কানে গোল গোল রিং। দু’হাত ছড়িয়ে উপরের দিকে মুখ করে বিদঘুটে ভাষায় সম্ভবত
মন্ত্র উচ্চারণ করছে। এই মনে হয় ওদের রাজা পুকান্দাকু।
জয়ন্ত যার কথা আসার সময়ে বলেছিল। আমাকে দেখে কটমট করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর
নিজের নেড়া মাথায় হাত বুলিয়ে কীসব বলল। তার বিন্দুবিসর্গ
বুঝতে পারলাম না আমি।
মনের
মধ্যে তোলপাড় চলছিল অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ জয়ন্তর নাম ধরে চিৎকার করে ডাকলাম। সে শুধু
আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকাল আমার দিকে। চোখদুটো টকটকে লাল।
আমার চিৎকার শুনে রাজার চোখদুটো যেন জ্বলে উঠল
দপ করে। তার সামনে পাথরের পাত্রে রাখা কালো পাউডারের মতো একটা জিনিস নিয়ে সেই লাল
আলোর ভেতরে ছুঁড়তে লাগল মুঠো মুঠো। ফলে কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠল সেখান থেকে।
সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। বামনগুলো হাঁটু মুড়ে মাথা মেঝেতে ঠেকিয়ে সমবেতভাবে
একটা বিকট আওয়াজ শুরু করেছে। আর রাজার মুখ দিয়ে বেরোছে অদ্ভুত এক সুরেলা মন্ত্র।
মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল। খুব নেশা হলে যেমন হয়, চারপাশটা ঘুরতে লাগল তেমন।
ধুপ করে বসে পড়লাম পাথরের মেঝেতে। আর একঝলক কালো ধোঁয়া নাকে এসে লাগতে বসে থাকাও
অসম্ভব হয়ে উঠল। চিত হয়ে শুয়ে পড়তে একদল বামন এসে সারা শরীরে দড়ি বাঁধতে শুরু করে
দিল। মাথাটা এমন ভোম হয়ে আছে যে তাদের
বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল না। তারপর চারদিক
থেকে টান করে জালের মতো কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে চলল আমাকে।
তন্দ্রাচ্ছন্ন
চোখে দেখলাম বেশ কিছুদূর বয়ে নিয়ে গিয়ে একটা পাথরের ছোট্ট নিচু ছাদওলা ঘরের মধ্যে
ঢুকিয়ে দিল আমায়। এরপর যেটা ঘটল সেটা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে এটাও
ঠিক যে যুক্তি বা বিজ্ঞান যা কিছু আমরা ছোটো থেকে শিখেছি সেগুলো সবই পৃথিবীর
উপরতলার চিন্তাভাবনা। পাতালপুরীতে সে হিসাব মিলবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।
মাঝে
কতটা সময় কেটে গেল জানি না। পড়ে আছি তন্দ্রাচ্ছন্ন
ঘোরের মধ্যে। অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে কিছুটা জ্ঞান ফিরতে টুম্বাকে দেখলাম জ্যান্ত
মানুষের মতো হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ঘরের মধ্যে ঢুকে সামনে দাঁড়িয়ে আমার
ভাষায় বলল, “তুমি বিনা অনুমতিতে মিলিন্দাকুঞ্চিতে এসে খুব ভুল কাজ করেছ। হুগুরারা
তোমাকে ঈশ্বরের কাছে বলি দেবে।”
আমি
ঢোঁক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে বলি দেবে কেন?”
“তোমার
গায়ের চামড়া সাদা, চুলের রং সোনালি। তোমরা হলে
মিলিন্দাকুঞ্চির শত্রু।”
“আমি
এদের কী ক্ষতি করেছি?”
“বহু
বছর আগে হুগুরাদের পূর্বতন রাজা যখন পরিকল্পনা করেছিলেন পৃথিবীর বুকে অন্ধকার
রাজ্য কায়েম করবেন, উপরতলার মানুষদের দাস বানিয়ে কাজ করাবেন নিজেদের অধীনে, তখন একজন
সাদা চামড়া সোনালি চুলের মানুষ এসে সমস্ত পরিকল্পনা ধ্বংস করে দিয়েছিল। আবার এত
বছর পর এরা শক্তি সংগ্রহ করেছে উপরের মানুষকে বশ করার জন্য।
তুমি ঠিক সেই সময়েই হাজির হলে। রাজা পুকান্দাকুর মতে গণ্ডগোল পাকানোর জন্যই তোমার
এখানে আবির্ভাব।”
আমি
বললাম, “তোমরা হয়তো জান না, সভ্য মানুষের বিজ্ঞান অনেক উন্নত। এরা কিছুই করতে
পারবে না।”
“রাজা
পুকান্দাকু এমন একটি ধোঁয়া তৈরি করেছেন যেটা শরীরে প্রবেশ করলেই মানুষের সমস্ত
বুদ্ধি জল হয়ে যাবে। তখন জড়বস্তুর সাথে তোমাদের কোনও পার্থক্য থাকবে না। মাটির নিচ
দিয়ে সুড়ঙ্গ করে উপরের সমস্ত শহরে পৌঁছে যাবে সেই ধোঁয়া। সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ চলছে
জোর কদমে। আর সেই কাজের জন্যই আমাদের প্রয়োজন ছিল একজন বুদ্ধিমান মানুষের। তাই
আমরা তোমার বন্ধুকে ধরে এনেছি। সে এখন রাজা পুকান্দাকুর তন্ত্রের জাল কেটে বেরোতে
পারবে না কিছুতেই। তুমি তার পিছু পিছু চলে এসেছ মরার জন্য। রাজা বলেছেন, সুড়ঙ্গ
তৈরির কাজ শেষ হবার পর মন্ত্রপূত ধোঁয়া উপরে পাঠানোর আগে আমাদের ঈশ্বরকে খুশি করতে
হবে। সেজন্য বলি দিতে হবে একজন মানুষকে যার
চামড়ার রং সাদা আর চুল সোনালি।”
আমি
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা টুম্বা, তুমি কি জীবন্ত প্রাণী?”
“আমি
টুম্বা নয়। আমার নাম বুরা। ওরই মতো
দেখতে আর একটা মন্ত্রপূত যন্ত্র। তবে আগে আমরা ছিলাম তোমাদেরই মতো পৃথিবীর উপরতলার
মানুষ। কেনিয়ায় একটা গুহার মধ্যে থেকে ধরে এনে আমার শরীরটাকে অপরাসায়ন আর
তন্ত্রবিদ্যার মাধ্যমে কাটুমকুটুমের আকৃতি দিয়েছে রাজা। ওনার অনেক শক্তি। টুম্বাকে
উপরের পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল সুড়ঙ্গ তৈরির উপযুক্ত একজন মানুষ খুঁজে আনতে। আর
আমাকে তোমার কাছে রাজাই পাঠিয়েছেন। কারণ, আমি উপরতলার মানুষের কুড়িটা ভাষা জানি।
এখানে আমার মতো প্রায় একশোটা কাটুমকুটুম আছে। সবাই এক একটা দিকে বিশেষজ্ঞ। আমাদের দেখতে
প্রায় একইরকম। পুকান্দাকু যা আদেশ দেন আমরা তাই পালন করি। পাতালপুরীতে আমরা হেঁটে
চলে বেড়াতে পারি। কিন্তু উপরের পৃথিবীতে গেলে আমরা জড়বস্তু।”
“বেশ,
শোন বুরা, তুমি শুধু তোমার প্রভুর কাছে আমার একটা বার্তা পৌঁছে দাও। তাঁকে গিয়ে
বল, যে আমি অত্যন্ত গর্বিত একজন মানুষ যার ভাগ্যে এমন একটা মহান সুযোগ এসেছে, যে
নিজের প্রাণ হুগুরাদের দেবতার কাছে উৎসর্গ করার।”
কথাটা
শুনে বুরা চলে গেল। জানি না আমার তির সঠিক নিশানায় লাগবে কি না। তবে চান্স তো একটা
নিতেই হবে। দু’তিনদিন কেটে গেল এইভাবেই। অবশ্য এখানে কোনও সূর্যের উদয় অস্ত নেই।
তাই সময়ের হিসাব এরা কীভাবে রাখে বুঝতে পারলাম না। আমার হাত ঘড়িটা চলছে ঠিকঠাক।
তাতেই সময় আর দিনের হিসাব পাচ্ছি। আমাকে এরা
এই ছোট্ট ঘর থেকে বেরোতে দিচ্ছে না। অফুরন্ত বন্দিদশা। অপেক্ষা শুধু সেইদিনের জন্য
যেদিন আমাকে বলি দেওয়া হবে। আমার ব্যাগটা ফেরত দিয়ে গেছে। এতে যে সাংঘাতিক
অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে সে বিষয়ে কোনও ধারণা এদের নেই। না
হলে এই ভুলটা এরা করত না। আপাতত ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে যতটা পারছি গুছিয়ে
লিখে রাখছি। জানি এ লেখা হয়তো উপরের সভ্য মানুষের হাতে কোনওদিনই পৌঁছাবে না।
২০শে
এপ্রিল, মিলিন্দাকুঞ্চির গুহা
অনেক
ভেবে রাস্তা একটা বের করেছি। তাতে হয়তো আমার প্রাণসংশয় হবে। তা হোক। জয়ন্তর
প্রাণটা তো বাঁচবে। তার থেকেও বড়ো কথা, এই পাতালপুরীর
হুগুরাদের বাঁদরামি উপরের মানুষকে সহ্য করতে হবে না।
তিনদিন
আগে যে তিরটা ছুঁড়েছিলাম অন্ধকারে সেটা লেগেছে অব্যর্থ নিশানায়। রাজা ডেকে
পাঠিয়েছেন আমাকে। গেলাম বুরার সাথে। সে আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করল।
পুকান্দাকু
বলল, “শুনলাম তুমি নাকি নিজের প্রাণ আমাদের দেবতার কাছে উৎসর্গ করার জন্য খুশি
হয়েছ?”
আমি
রাজার সামনে জোড়হাত করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। স্ক্রিপ্ট বানানোই ছিল। নাটকীয়
ভঙ্গিতে বললাম, “মহারাজের জয় হোক। উপরের তলার মানুষেরা বিজ্ঞানের নামে শুধু বড়ো বড়ো
মারণযন্ত্র বানাচ্ছে। ওরা একদিন নিজেদের মধ্যে মারামারি করে পৃথিবীটাকে হয়তো ধ্বংস
করে ফেলবে। এর থেকে ঢের ভালো আপনার দাসত্ব করা। আপনিই পৃথিবীর প্রকৃত রাজা। যদি
আদেশ করেন তবে এখুনি নিজের প্রাণ আপনার পায়ে বলি দিতে পারি।”
কথাটা
শুনে পুকান্দাকু খুব খুশি হলেন মনে হল। উপরের জগতের প্রাণীর কাছ থেকে নিজের
সম্পর্কে এত ভালো কথা শুনে মুখমণ্ডলে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠল। বুক উঁচু করে আমার
মাথার কাছে দু’পাক ঘুরে রাজা বলল, “মনে হচ্ছে এতদিন পরে দেবতা খুশি হয়েছেন আমার
উপর। তাই হয়তো তোমাকে পাঠিয়েছেন আমার কাছে। বেশ, তোমাকে মুক্তি দিলাম বন্দিদশা
থেকে। তবে পালিয়ে তুমি যেতে পারবে না কোনওদিনই। ফেরার পথ অত সহজ নয়। যে না জানবে,
পচে মরবে গোলকধাঁধায়। শীঘ্রই তোমার দীক্ষা হবে দেবতার সামনে। তারপর থেকে তোমার
মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করব আমি। তুমি আমাদেরই একজন হয়ে চিরকাল থেকে যাবে এখানে।”
সেখান
থেকে ফেরার সময়ে আরও একটা কথা জানলাম বুরার কাছে।
সেটা হল রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে মানুষ এখানে আসে, সে যদি পালিয়ে যায় উপরের
পৃথিবীতে তাহলে তার শরীর কাটুমকুটুমের আকার নেবে। আর চিরকাল তাকে কাটাতে হবে জড়বস্তু
হয়ে।
যাক,
সেসব ভাবার সময় এখন নয়। এখন যেটা চাই সেটা হল একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। ভেবেছি
আমি রাজার কাছে আবার যখন যাব দীক্ষা নিতে, নিজের অস্ত্রশস্ত্রগুলো আগে থেকেই
লুকিয়ে রাখব পোশাকের নিচে। আর সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ব পুকান্দাকুর উপর। আমি
নিশ্চিত একটা গুলিতেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ হবে। আর তখন হুগুরারা দিশেহারা হয়ে পড়বে। কারণ,
এই ক’দিনে যা বুঝেছি যতরকম বদবুদ্ধি সবই ঐ রাজার মাথা থেকে বেরোচ্ছে। বাকিদের
মাথায় মনে হয় বুদ্ধি জল হয়ে গেছে আগে থেকেই। ওরা শুধুমাত্র আজ্ঞা নির্বাহকারী
পুতুল। এরপর ওদেরকে ভয় দেখিয়ে জয়ন্তকে নিয়ে উপরে ফিরে যাওয়া খুব একটা শক্ত কাজ হবে
না। আর সঙ্গে আনা ডিনামাইট স্টিকগুলো দিয়ে ঐ লাল জ্বলন্ত আলোর স্তম্ভটিকে গুঁড়িয়ে
দিতে হবে। ওটাই এদের প্রাকৃতিক শক্তির উৎস। দেখা যাক কী আছে কপালে।
৩০শে
এপ্রিল, মিলিন্দাকুঞ্চির গুহা
অনেকদিন
হতে চলল ঘুরছি গোলকধাঁধার মধ্যে। জানি না আদৌ কোনওদিন বেরোতে পারব কি না এখান
থেকে। নাকি পুকান্দাকুর কথামতো এর ভেতরেই পচে মরব আমরা। চারপাশে এখন জমাট বাঁধা
অন্ধকার। ব্যাটারির আলোর তেজও কমে আসছে। সামনে পেছনে শুধুই গুহাপথ। পুকান্দাকুর
পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। তবে কালাজাদুর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে
পারব কি না জানি না। আমার শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছে এবং সেটা বাড়ছে ক্রমশ।
হাত পা যেন শক্ত হয়ে আসছে। খুব কষ্ট করে লিখছি। তাড়াতাড়ি ব্যাপারটাকে যতটা পারি খাতাবন্দি
করতে হবে। এদিকে জয়ন্তর অবস্থা খুব সঙ্গিন। ওর মাথাটা একেবারে কাজ করছে না। হয়তো
এটা পরিবেশের প্রভাব। উপরের আবহাওয়াতে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। এমনিতেও এখানের বাতাসে
অক্সিজেন কম।
কিছুদিন
আগে একটা বইয়ে পড়েছিলাম, প্রকৃতি নিজেই তার ভারসাম্য রক্ষা করে। মানে কোনও জায়গায়
যদি গাছপালা, বন হঠাৎ করে সাফ করে ফেলা হয় তাহলে সেখানে বন্যা বা সাইক্লোন অবশ্যম্ভাবী।
প্রকৃতি নিজেই সেখানে সবকিছু ধ্বংস করে আবার প্রথম থেকে শুরু করে। তেমনই প্রতিটা
ঘটনার পেছনে থাকে আর একটি ঘটনা। প্রথমটিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে সূত্র পাওয়া যাবে
আগেরটি থেকে। এক্ষেত্রেও যেটা ঘটল সেটাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এই মতবাদই জোরালো হয়।
বলা বাহুল্য, আমার অতো তোড়জোড় কিছুই কাজে আসেনি। ডিনামাইটের
স্টিক, বন্দুক, এমনকি ছুরিও বের করতে হয়নি আমাকে। যা ঘটার তা আপনা থেকেই হল। তার
জন্য যদি কেউ দায়ী হয় তা পুকান্দাকু নিজে। অতিরিক্ত লোভ ওর সর্বনাশ ডেকে আনল। আমার
চোখের সামনে সবকিছু গুঁড়িয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
সেদিন
চব্বিশ ঘণ্টা কাটার আগেই পুকান্দাকু ডেকে পাঠাল আমাকে। যথারীতি পরিকল্পনা অনুযায়ী
তৈরি হয়েই ছিলাম। বুরার সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম রঙ্গমঞ্চের কেন্দ্রস্থলে। লাল গোল
আলোর স্তম্ভের পাশে একটা লম্বা পাথরের উপর বসতে বলা হল আমাকে। ব্যাগটা পিঠ থেকে
খুলে পাশে রেখে উঠে গেলাম পাথরের উপরে। জয়ন্তকে এখানেই দেখেছিলাম আগেরদিন। আজকে
তাকে দেখছি না ধারে কাছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সে আজকে কাজে ব্যস্ত। কোথায় কাজ
চলছে জানতে চাইতে বুরা বলল, “মাইলখানেক দূরে একটা সুড়ঙ্গপথের সামনে আড়াআড়ি একটা
মোটা পাথরের স্ল্যাব রয়েছে। কিছুতেই ফুটো করা যাচ্ছিল না এতদিন। উনি
সেখানেই কাজ করছেন।”
এরপর
শুরু হল পুকান্দাকুর বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্রের খেল। ঘণ্টা চারেক ধরে চলল। সহ্য করলাম
দাঁতে দাঁত চেপে। একটা জিনিস আমি আগেরদিনই বুঝেছিলাম, যে ওর যত কারসাজি সব ঐ
ধোঁয়ার মধ্যে। বিশেষভাবে তৈরি রাসায়নিক ধোঁয়াটা শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে নার্ভাস
সিস্টেমকে অকেজো করে দেয়। তারপর সম্মোহনের মাধ্যমে মস্তিষ্ক
নিয়ন্ত্রণ করে পুকান্দাকু। অনেক ভেবে
একটা রাস্তা ঠিক করে রেখেছিলাম। সেটা হল,
ব্যাগের ফার্স্ট এইড বক্সে যে তুলো ছিল সেখান থেকে কিছুটা নিয়ে জলে ভিজিয়ে পাতলা
করে নাকের দুটো ফুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছি। এর ফলে নিঃশ্বাস নিতে সামান্য অসুবিধা
হচ্ছে ঠিক কথা, কিন্তু আমার ধারণা যে কোনও গ্যাস নাকের ভিতরে প্রবেশ করার সময়ে ঐ
ভিজে তুলোর সংস্পর্শে এসে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।
বাস্তবে
সেটাই হল। ফলে পুকান্দাকুর তৈরি গ্যাসের প্রভাব থেকে অনেকটা নিস্তার পাওয়া গেল।
কিন্তু অভিনয় করলাম যেন আমি ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়লাম
পাথরের উপর। ভাবছি রাজা আমার কাছাকাছি আসলেই ছুরিটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব ওর উপর। গলার
নলিতে শক্ত করে ধরে বুরার মাধ্যমে হুকুম করব, আমাদের মুক্তি দাও নইলে ধড় থেকে
আলাদা করে দেব মুণ্ডু। আশা করি এতে করে কাজ হবে।
তখন
পাথরের উপর শুয়ে আছি টানটান হয়ে। পুকান্দাকু একঘেয়ে সুরে মন্ত্র উচ্চারণ করছে দূরে। দু’জন
হুগুরা এসে পাত্র থেকে কী একটা ঈষদুষ্ণ তরল ঢেলে দিল গায়ে। চিড়বিড় করে উঠল শরীরটা।
চোখের পাতা সামান্য ফাঁক করে দেখলাম পুকান্দাকু এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমিও ধীরে
ধীরে প্যান্টের সাইড পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলাম ছুরিটা। রাজা দু’তিন
হাতের মধ্যে চলে এসেছে। ঠিক যে মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে ছুরিটা তার গলায় ধরতে যাব,
মাথার উপরে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
প্রচণ্ড
শব্দে কেঁপে উঠল গুহাটা। থরথর করে কেঁপেই চলেছে। তার মধ্যে শুরু হল একটা চিৎকার।
হো হো... হো... হো...। মাথা তুলে দেখলাম লক্ষ লক্ষ হুগুরা
দৌড়োচ্ছে। এদিকেই আসছে সব। সঙ্গে সঙ্গে গন্ধকের ঝাঁজালো গন্ধে ভরে গেল গুহাটা।
সবাই আতঙ্কিত গলায় একযোগে রাজার সামনে এসে কিছু বলছে।
বুরা
আমার মাথার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল তখন। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
সে
নির্বিকার গলায় জানাল, “পাথরের স্ল্যাব ভাঙতে গিয়ে আগ্নেয়গিরির পথ খুলে গেছে।
লাভার স্রোত এগিয়ে আসছে এদিকে। পথটা পুকান্দাকুর দশ পুরুষ আগে এক রাজা বন্ধ করে
দিয়েছিলেন।”
প্রথম
মনে হল জয়ন্তর কথা। ও তো সেখানেই গিয়েছিল কাজ করতে! তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
দূর থেকে চোখে পড়ল, সে দৌড়ে আসছে এদিকেই। আমিও এই হৈ-হট্টগোলের মধ্যে ব্যাগটা তুলে
নিয়ে দৌড় লাগালাম প্রাণপণে। জ্বলন্ত লাল স্রোত ধেয়ে আসছে গলগল করে। জয়ন্তর হাতটা
ধরে এক টান মেরে সরিয়ে এনেছি হুগুরাদের মধ্যে থেকে। কিছুটা ডানপাশ ঘেঁষে দৌড়ে অন্য
একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেলাম। শেষমুহূর্তে পেছন ফিরে দেখলাম, লাভার স্রোতের
মধ্যে পড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার হুগুরা। রাজাকে দেখতে পেলাম না কোথাও।
সেই লাল আলোর স্তম্ভটার উপর লাভা এসে পড়ায় সেটা নিভে আসছে ক্রমশ। চারপাশে
বিচ্ছুরিত লাল আলোটা ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। আমি এই গুহার শুরুতে একটা ডিনামাইট
স্টিক দিয়ে ছোট্ট বিস্ফোরণ করতে মুখটা বন্ধ হয়ে গেল পাথর চাপা পড়ে। তারপর থেকে
এগিয়ে চলেছি এখনও পর্যন্ত।
আর
পারছি না লিখতে। পেশিগুলোতে টান লাগছে। মাথাটা মনে
হচ্ছে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাবে।
এই
পর্যন্ত পড়ে ডায়েরিটা বন্ধ করলেন রাঙাদিদা। তোর্সা, বুলটাই আর রিমা একসাথে চেঁচিয়ে
উঠল, “তারপর?”
“এরপর
কী ঘটেছিল সেটা সঠিকভাবে জানার কোনও উপায় নেই। তবে তোদের দাদু যখন বাড়ি ফিরে
এসেছিলেন, তখন নাকি তাঁর সারা শরীরে ছিল অনেক ক্ষত। যুদ্ধক্ষেত্রে
দীর্ঘদিন থাকলে সৈন্যদের যেমন হয় আর কী। জয়ন্তর যখন
জ্ঞান ফিরেছিল, তখন সে নাকি উগাণ্ডাতে ভিক্টোরিয়া লেকের পাশে ‘এন্টেব্বে’ নামে এক
জনপদে। মিকুমি থেকে এন্টেব্বের দূরত্ব
আনুমানিক বারোশো কিলোমিটার। তার মানে গুহার পরিধিটা ভেবে দেখ একবার।”
বুলটাই
হঠাৎ পাশে বসা কাটুমকুটুমটিকে হাতে নিয়ে বলল, “আচ্ছা দিদা, এই কাটুমকুটুমটাই তো
দাদুর সাথেই এসেছিল আফ্রিকা থেকে?”
“হ্যাঁ,
সে কথাটা প্রথমেই বলেছি তোদের।”
“একটা
জিনিস ভেবে দেখেছ কখনও? টুম্বা দাদুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মিলিন্দাকুঞ্চির
গুহায়। কিন্তু যে কাটুমকুটুমটা বেরিয়েছিল দাদুর সাথে সে টুম্বা হতে পারে না।”
তোর্সা
বলল, “তার মানে?”
“বুরা
বলেছিল রাজার অনুমতি ছাড়া যদি কেউ উপরের পৃথিবীতে যায় তাহলে সে কাটুমকুটুম হয়ে
যাবে। তার মানে দাদু যে কাটুমকুটুমকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সেই তো বাসিলো।”
“এটা
তো ভেবে দেখিনি,” বললেন রাঙাদিদা।
রিমা
বলল, “কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে দাদুও তো কাটুমকুটুম হয়ে যেত।”
বুলটাই
একটু ভেবে জানাল, “দাদুকে তো নিয়ে গিয়েছিল সুড়ঙ্গ বানানোর কাজে। আর বাসিলো সেখানে
অনধিকার প্রবেশ করেছিল। সে জন্য যুক্তির দিক থেকেও দু’জনের ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা
হবে, এটাই স্বাভাবিক।”
রাঙাদিদার
চোখটা ছলছল করে উঠল, “বুলটাই ঠিকই বলেছিস। এটাই তাহলে
বাসিলো! মিলিন্দাকুঞ্চির গুহায় তোর দাদুর প্রাণ বাঁচিয়েছিল।”
“দেখ
দেখ, এর চোখেও জল!” তোর্সার কথা শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল, কাটুমকুটুমের চোখদুটো
যেন সত্যিই ছলছল করছে।

_____
অলঙ্করণঃ
লেখক
besh guchiye lekha, tobe tothyo gulo dewar age ektu bhalo kore pore newa dorkar
ReplyDeletedarun...........
ReplyDelete