পর্দায়
আধুনিক রূপকথাঃ ম্যালফিশ্যন্ট
ঋজু
গাঙ্গুলী
রাজা স্টেফান
আর তাঁর রানি লিয়ার মনে বড়ো কষ্ট। হবে না? তাদের কোনও ছেলেমেয়ে নেই যে! তারপর
একদিন রানির কোল জুড়ে এল তাঁদের সন্তান, এক ফুটফুটে মেয়ে। ভোরের নতুন আলোর মতো
ঝলমলে সেই মেয়ের নাম রাখা হল অরোরা। রাজ্য জুড়ে ছুটি ঘোষণা করা হল যাতে সব্বাই এসে
রাজকন্যাকে দেখে যেতে পারে, তাকে সম্মান জানাতে পারে, আশীর্বাদ করতে পারে।
খুব আনন্দ
হল সেদিন। এমনকি, স্টেফানের বন্ধু রাজা হিউবার্টের ছেলে ফিলিপের সঙ্গে অরোরার
বিয়েটাও পাকাপাকি করে ফেলা হল, যাতে দুই রাজ্য একসঙ্গে থাকতে পারে। তিনজন খুব ভালো
পরিও এলেন অরোরাকে আশীর্বাদ করতে আর উপহার দিতে। ফ্লোরা দিলেন রূপ, ফনা দিলেন
সঙ্গীত।
কিন্তু তার
পরেই হল ভীষণ বিপদ! এক দুষ্টু পরি, যার নাম ম্যালফিশ্যন্ট, আর যাকে কেউ ভয়ে
নেমন্তন্ন করেনি, সে হঠাৎই অনুষ্ঠানে এসে রেগে আগুন হয়ে অভিশাপ দিল - অরোরার
ষোলোতম জন্মদিনে সূর্যাস্ত হওয়ার আগেই একটা সুতো কাটার টাকুতে হাত কেটে যাবে তার, আর তারপরেই সে মারা যাবে। এই
ভয়ংকর অভিশাপ শুনে রাজ্যের সবাই যখন শোকে-ভয়ে প্রায় বেহুঁশ, তখন এক ভালো পরি
মেরিওয়েদার, যাঁর আশীর্বাদ আর উপহার দেওয়া তখনও বাকি ছিল, অভিশাপটাকে একটু বদলে
দিলেন।
হ্যাঁ, অরোরার হাত কেটে যাবে। কিন্তু তারপর সে মারা যাবে
না। বরং সে ঘুমিয়ে পড়বে গভীরভাবে, যতদিন না তাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে এমন কেউ চুমু
খেয়ে তাকে জাগিয়ে তোলে।
তারপর?
গল্পটা চেনা চেনা লাগছে না? লাগতেই হবে। ১৯৫৯ সালে ওয়াল্ট
ডিজনি স্টুডিওর বানানো এই অ্যানিমেটেড মিউজিকাল ফিল্মটি দেখেনি এমন কেউ আছে নাকি?
নামটা বলতে হবে এর পরেও? আচ্ছা আচ্ছা! সিনেমাটা হল ‘স্লিপিং
বিউটি’।

৭০ মিমি ওয়াইড স্ক্রিন ফরম্যাট, রঙের গভীরতা, অসাধারণ
জনপ্রিয় কিছু গান এসবের পাশাপাশি এই সিনেমাটা কিন্তু সমালোচক থেকে দর্শক, সবার
কাছে প্রশংসিত হয়েছিল একটি বিশেষ চরিত্রের উপস্থিতির জন্যে। কে ছিল সে?
আর কেউ নয়,
সে ছিল দুষ্টু পরি ম্যালফিশ্যান্ট, যার উপস্থিতি কচিকাঁচা দর্শকদের এতটাই ভয় ধরিয়ে
দিয়েছিল যে ডিজনি ভিলেইন নামে একটা আস্ত
ফ্র্যাঞ্চাইজ-ই চালু হয়ে গেছিল এই সিনেমার পর।

তবে আজ থেকে
প্রায় ষাট বছর আগে মনে না হলেও, এখন তো আমাদের সবার মনেই এই প্রশ্নটা জাগে, যে এমন
শক্তিশালী এক পরি শুধু নিমন্ত্রণ পায়নি বলে একরত্তি একটা মেয়েকে এমন অভিশাপ কেন
দেবে? তাছাড়া, এতদিনে তো ডিজনি মিউজিকালের বাইরে এই গল্পর আসল, অন্ধকারাচ্ছন্ন আর
হিংস্র চেহারাটা আমরা অনেকেই জেনে গেছি। তাই না?
১৩৩০ থেকে
১৩৪৪-এর মধ্যে রচিত, কিন্তু ১৫২৮-এ প্যারিসে প্রথমবার প্রকাশিত ছ’টি বইয়ের সংকলন
আর্থারিয়ান রোমান্স ‘পার্সফরেস্ট’-এর তৃতীয় বইয়ে এই প্রবাদের আদি এবং ক্রুর চেহারাটা
ধরা পড়ে। এই বইয়ের অনূদিত রূপটি নিয়ে ইতালির কবি গ্যামবাতিস্তা বেসিল লেখেন ‘সান,
মুন, অ্যান্ড তালিয়া’, যা তাঁর মৃত্যুর পর ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। সেই
গল্পের মার্জিত ও লিখিত রূপটি ধরা পড়ে ১৬৯৭-এ প্রকাশিত শার্ল পেরঁ-র লেখা ফরাসি
ক্লাসিকে, যার নামটি ছিল ‘দ্য বিউটি স্লিপিং ইন দ্য উড’। ১৮১২-য়
জ্যাকব গ্রিম এই গল্পের মৌখিক রূপটি জার্মান ভাষায় সংকলিত করেন ‘লিটল ব্রায়ার রোজ’
নামে। কিন্তু কেন ম্যালফিশ্যন্ট রাজা-রানি-রাজকন্যার ওপর এত রেগে গেছিল, সেটার
ফয়সলা হয়নি। যতদিন না ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স
ঘোষণা করে যে তারা এবার এমন এক সিনেমা বানাতে চলেছে, যাতে গল্পটা বলা হবে
ম্যালফিশ্যন্টের দৃষ্টিকোণ থেকে। ২০১০ সালের সেই ঘোষণার পর, অনেক টানাপোড়েন
পেরিয়ে, ২০১৪-য় দস্তুরমতো থ্রিডি এবং আইম্যাক্স-এ আত্মপ্রকাশ করে সিনেমাটা।

এই সিনেমায়
প্রটাগনিস্ট হল ম্যালফিশ্যন্ট নামের পরি, যে এক রাজ্যের সীমায় অবস্থিত জাদুকরি
মায়ায় ভরা মুর-এর বাসিন্দা। ছোট্টবেলাতেই তার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা হয়েছিল এক চাষির
ছেলে স্টেফানের।
ম্যালফিশ্যন্ট
বড়ো হয়ে যখন জলাজমি আর সেখানকার সব প্রাণীর রক্ষকের দায়িত্ব পালন করছে, তখন একদিন
পাশের রাজ্যের রাজা হেনরি মুর দখল করার জন্যে সৈন্যসামন্ত নিয়ে চড়াও হলেন সেখানে।
যুদ্ধ হল। ম্যালফিশ্যন্টের প্রতি-আক্রমণে সাংঘাতিক আহত হেনরি ফিরে গিয়ে
মৃত্যুশয্যায় ঘোষণা করলেন, যে ম্যালফিশ্যন্টকে মারতে পারবে, সেই হবে রাজ্যের রাজা।
লোভী স্টেফান তখন ম্যালফিশ্যন্টের সঙ্গে দেখা করে, আর তাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে
দেয়। কিন্তু ম্যালফিশ্যন্টকে সে প্রাণে ধরে মারতে পারে না। তার বদলে
ম্যালফিশ্যন্টের সবচেয়ে জোরের জায়গা, তার ডানাজোড়া সে কেটে নিয়ে রাজার কাছে পেশ
করে ম্যালফিশ্যন্টকে হত্যা করার প্রমাণ হিসেবে।
এই
বিশ্বাসঘাতকতা কেমন লেগেছিল মহাশক্তিধর পরি ম্যালফিশ্যন্টের?

রাগে দুঃখে
ম্যালফিশ্যন্ট নিজেকে মুরের রানি বলে ঘোষণা করে, আর ডিয়াভাল নামের এক দাঁড়কাককে
মানুষের রূপ দেয় তার হয়ে চরবৃত্তি করার জন্যে। সে-ই একদিন খবর আনে, ততদিনে রাজা
হওয়া স্টেফান আর তার রানি লিয়া এক জাঁকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে তাদের মেয়ের
জন্মোৎসব তথা নামকরণ উপলক্ষে। প্রতিহিংসায় অন্ধ ম্যালফিশ্যন্ট সেই অনুষ্ঠানে হাজির
হয়, অনাহূত।
আর তারপর?
উফ!
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির অতুলনীয় অভিনয়, দুর্ধর্ষ সিনেমাটোগ্রাফি, গা-ছমছমে থেকে
মনমাতানো মিউজিক, অ্যাকশন, মর্মস্পর্শী কাহিনি, মমত্ব আর হালকা হাসির ছোঁয়ায়
স্মরণীয় কিছু সিকোয়েন্স, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে একেবারে শেষমুহূর্তে প্রিয়
চরিত্রদের ফিরে আসা, সব মিলিয়ে সিনেমাটা দেখার পর একটাই কথা মনে হয়।
এই যুগের
রূপকথা এমনই হওয়া উচিত।
মানুষের মনে
অন্ধকার থাকবেই। লোভ, ঈর্ষা, রাগ, অভিমান এসব কালো মেঘে মনের নীল আকাশ ঢাকা পড়বেই।
প্রিয় বন্ধুরা একদিন দূরে চলে যাবে। হঠাৎ বোঝা যাবে, যাকে মনের মানুষ ভেবেছিলাম,
সে আসলে একদম অন্যরকম, এক্কেবারে অচেনা। তবু, তার মধ্যেও থাকবে বেঁচে থাকার মানে।

তার মধ্যেও
থাকবে আনন্দ।

তার মধ্যেই
থাকবে নিজের আসল জোর খুঁজে পাওয়ার রাস্তা।

আর সেই
রাস্তা দিয়েই খুঁজে নিতে হবে নিজের কাছের মানুষদের, আর নিজেকে।
এই বিপন্ন
সময়েও ছোটোদের বড়োমানুষ হওয়ার মতো জোর যোগায় এই সিনেমা। তাই বলছিলাম, এখনও যদি
সিনেমাটা দেখে না থাক, তাহলে এইবেলা দেখে নাও চটপট।
_____
ছবিঃ
আন্তর্জাল
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteছবিটা অসাধারণ লেগেছিল, লেখাটাও পড়ে খুব ভাল লাগল
Delete