
পরীক্ষায় পরিদাদু
জয়দীপ চক্রবর্তী
“তুমিই তো পরিদাদু!” কথাটা যে বলল তার মাথাটা শাওনের কাঁধের সামান্য নিচে। মাথায় ছোটো করে
ছাঁটা চুল। কথায় অদ্ভুত একটা হিন্দি হিন্দি টান আছে, “দাঁড়াও, এই ক্যামেরায় তোমার
আর শাওনদাদার একটা ছবি তুলে নিই ঝটাকসে।”
শাওনের বেশ মজা লাগছিল তার
কথা শুনতে। তার দিকে চেয়ে শাওন বলল, “কিন্তু এই স্মার্টফোনটা কার?”
“আমার মায়ের।”
“মা জানে, তুমি ওনার ফোন নিয়ে
নিজের কাছে রেখেছ? আমার মা কিন্তু আমাকে বড়োদের ফোনে একদম হাত দিতে দেয় না।”
“হ্যাঁ, আমিই পরিদাদু,” একগাল
হেসে পরিদাদু তার দুই কাঁধে নিজের দু’হাত রাখলেন, “তুমি আমাদের চেন?”
“কেন চিনব না!” ছেলেটা ঠোঁট
উলটে বলে, “তোমাদের কত গল্প শুনেছি আমি মিষ্টি আন্টি আর রণিত আঙ্কলের কাছে।”
পরিদাদু ছেলেটার হাত থেকে ফোন
নিয়ে বললেন, “দেখি, কেমন ছবি তুললে আমাদের?”
“দাঁড়াও, আমিই ছবি দেখাচ্ছি
তোমায়,” বলে ফোনটা পরিদাদুর কাছ থেকে আবার নিজের হাতে নিল সে। পরিদাদুকে এক্ষুনি
তোলা ছবিটা ও আরও ছবি দেখাতে দেখাতে বলতে লাগল, “আমিও বড়ো হয়ে তোমার মতন
সেনাবাহিনীতে কাজ করতে চাই। আমাদের দেশের যারা শত্রু তাদের আমি কিছুতেই শাস্তি না
দিয়ে ছাড়ব না, দেখবে তুমি তখন।”
“তুমি তো তার মানে দেশকে খুব
ভালোবাসো!” পরিদাদু তারিফের গলায় বললেন।
“বাসব না! কী বলছ তুমি! দেশ
যে মায়ের মতন। বড়ো বড়ো মহাপুরুষেরা বলেছেন এই দেশকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে হয়।
ভালোবাসতে হয় জান প্রাণ দিয়ে।”
“সাবাশ!” পরিদাদুর চোখ চকচক
করে উঠল, “তোমার মতন ছেলেদেরই তো দরকার এখন এই দেশে।
কিন্তু কী লজ্জার কথা বল দেখি, তুমি আমায় এমন করে চেন অথচ আমি তোমার নাম জানি না
এখনও।”
“আমি সোম। মানে সবাই আমায় সোম
বলেই ডাকে। কিন্তু আমার নাম সৌম্য। সৌম্য গুহ।”
“বলছে তো দেশকে মায়ের মতন
ভালোবাসতে হয়। কিন্তু জিজ্ঞেস করুন তো, মাকে সত্যি সত্যি ও
ভালোবাসে কি না,” ট্রেতে করে পরিদাদুর জন্যে চা আর শাওনের জন্যে শরবত নিয়ে পরদা
সরিয়ে এই ঘরে ঢুকলেন গুহ আন্টি।
“সেকি! মাকে তুমি ভালোবাসো
না?” পরিদাদু না, শাওনই বলে উঠল হাল্কা হেসে।
“বাসি,” বলে মাথা নিচু করে
দাঁড়াল ছেলেটা।
“ঘোড়ার ডিম,” গুহ আন্টি ওর
থুতনি ধরে মুখটা সোজা করে দিয়ে বললেন, “মাকে ভালোবাসলে ও তো আমার কথা শুনত,
লক্ষ্মীছেলে হয়ে থাকত সবসময়। এমন দস্যিপনা করত কি সবসময়?”
“তুমি বুঝি খুব দুষ্টুমি
করো?” আবার জিজ্ঞেস করল শাওন।
“করে না আবার!” গুহ আন্টি টি-টেবিলের
ওপরে ট্রেটা রাখতে রাখতে বললেন, “সর্বসময় মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করছে। সঙ্গে
আমার কত্তাও আছেন। দিব্বি শিং ভেঙে ছেলের সঙ্গে নানানরকম কুবুদ্ধিতে মদত যোগাচ্ছেন
ছেলেকে। আমার অবস্থাটা একবার ভাবুন তো! কী যে বিপদে পড়ি না মাঝে মাঝে এদের নিয়ে!
দু’জনে মিলে যুক্তি করে আমায় বোকা বানায় দিনরাত। শক্ত
শক্ত পাজল জিজ্ঞেস করে, গোয়েন্দা গল্পের ক্লু দিয়ে বলে কে অপরাধী তা গেস করতে।
আমি গবেট। বেশিরভাগ সময়েই আমার গেস রং হয় আর ওরা মজা পেয়ে
হাততালি দেয়, জানেন!”
শাওনের খুব মজা লাগছিল।
মিষ্টিমাসি ঠিক যেমনটা বলেছিল এক্কেবারে তাই। মিষ্টিমাসির আসল নাম সুকন্যা। একসময়
সুছন্দার সঙ্গে কলেজে একসঙ্গে পড়তেন। খুব গলায় গলায় বন্ধুত্ব ছিল দু’জনের। কিন্তু
যা হয়। কলেজ পাশ করে বেরিয়ে যাবার পরে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেল ক্রমশ। তারপর বিয়ে থা
হয়ে যাবার পরে সম্পর্কটা একেবারেই হারিয়ে গিয়েছিল। মাঝে দীর্ঘদিন আর যোগাযোগই ছিল
না কোনও। সম্প্রতি ফেসবুকে আবার যোগাযোগ হয়েছে
দু’জনের। ব্যস, তারপর থেকেই সুকন্যামাসির বায়না, আসতেই হবে এখানে। কোনও কথা শুনতে
চাই না।
সুকন্যামাসির গল্প মায়ের কাছে
প্রচুর শুনেছে শাওন। মায়ের মুখে তাঁর সেই মিষ্টি
বন্ধুত্বের গল্প শুনে তখন থেকেই সুকন্যাকে মিষ্টিমাসি নাম দিয়েছিল শাওন। জানতই না
তখন সত্যি সত্যিই তাঁর সাথে দেখা হতে পারে তাদের আবার কোনোদিন। ফেসবুকে
মিষ্টিমাসির ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠে এমন চেঁচিয়ে উঠেছিলেন
সুছন্দা যে অরুণাংশু তো ঘাবড়েই গিয়েছিলেন প্রথমটা। ভেবেছিলেন নির্ঘাত কিছু একটা
সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। নিদেন আস্ত একটা আরশোলা উঠে গেছে সুছন্দার পা বেয়ে গায়ের
ওপর।
মিষ্টিমেসো রেলে চাকরি করেন।
কর্মসূত্রে থাকেন মোগলসরাইতে। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট কলোনির রেল কোয়ার্টারে। গরমের
ছুটি পড়ার সময় থেকেই অরুণাংশুর কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছিলেন সুছন্দা, “পুজোর
ছুটিতে কিন্তু মোগলসরায়ের টিকিট কাটবে। কোনও কথা শুনতে চাই না। সুকন্যাকে কতদিন দেখিনি।
ওর বাড়িতে যেতেই হবে। দু’একদিন ওখানে কাটিয়ে কাশী বিশ্বনাথ আর মা অন্নপূর্ণাকে
দর্শন করে ফিরে আসব আমরা। খুব লম্বা ট্যুর তো কিছু নয়। সাকুল্যে সাতদিন লাগবে
বড়জোর।”
“পরিদাদু আমাদের সঙ্গে যাবে
না?” শাওন জিজ্ঞেস করেছিল।
“যাবে না মানে!” সুছন্দা চোখ
গোল করে বলেছিলেন, “পরিকাকুকে না নিয়ে গেলে সুকু আমায় ঢুকতেই দেবে না। এত গল্প
শুনেছে আমার কাছে, পরিকাকুকে সঙ্গে করে নিয়ে যদি না যাই খুনও করে ফেলতে পারে ও
আমায়।”
পরিদাদু কিন্তু প্রথমটা নিজেই
না না করেছিলেন শুনে। বলেছিলেন, “তোর বন্ধুর বাড়ি। তোরা নিজেরাই ঘুরে আয় না খুকু।
আমায় নিয়ে আবার টানাটানি কেন?”
সুছন্দা ওনার আপত্তি পাত্তাই
দেননি। অরুণাংশুও বললেন, “তুমি না গেলে আমার আর শাওনের অবস্থাটা কী হবে ভেবেছ পরি?
খুকু তো তার বন্ধু সুকুর সাথে মিলে যাবে। আমাদের কথা মনে থাকবে তখন আর ওর? তুমি
গেলে তবু আমরাও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচব নিজেদের মধ্যে কথা কয়ে।”
অগত্যা প্রতিবাদ স্থগিত রেখে
একসঙ্গে সকলের জন্যেই ভায়া ইলাহাবাদ মুম্বাই মেলে টিকিট কেটে ফেলা। মিষ্টিমাসির
বাড়ি এসে পৌঁছনোর পরে কিন্তু সুছন্দারই মতন দিব্বি জমে গেছেন অরুণাংশু।
মিষ্টিমাসির হাজব্যান্ডের নাইট শিফট চলছে এখন। সকালে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে নেন খানিক।
ব্যস, তারপর থেকেই অরুণাংশুর সাথে জমিয়ে আড্ডা। মিষ্টিমাসিও চায়ের যোগান দিয়ে
যাচ্ছে ঘন্টায় ঘন্টায়। ব্যস, অরুণাংশু বেজায় খুশি। কাজেই আজও বাড়িতেই রয়ে গেছেন
তিনি রণিত আঙ্কলের সঙ্গে। মিষ্টিমাসিই পরিদাদু আর শাওনকে নিয়ে কয়েকটা কোয়ার্টার
পরে গুহ আঙ্কলের বাড়ি নিয়ে এসেছেন। সুছন্দা থেকে গেছেন বাড়িতে। তাঁর না থেকে উপায়
নেই। মিষ্টিমাসি এবং তিনি দু’জনেই চলে এলে রণিত আর অরুণাংশুকে চা এবং টুকিটাকি খাবারদাবারের
যোগান দেবে কে?
মিষ্টিমাসি বললেন, “জানেন
পরিকাকু, আমাদের গুহদা কিন্তু দারুণ মানুষ। চাকরির চাপ সামলেও নিয়মিত প্রচুর বই
পড়েন। কলকাতা থেকে নিয়মিত বই আনান। ফি বছর কলকাতা বইমেলার সময় ছুটি নিয়ে কলকাতা
যান স্রেফ বই কিনতে। থ্রিলার, গোয়েন্দা, অভিযান, রহস্য এসব বইয়ের পোকা একেবারে বাপ
ছেলে দু’জনেই। আর শ্বেতাও কিন্তু কম যায় না। আপনার সামনে বোকা সাজছে অমন ইচ্ছে করে।
ও নিজেও কিন্তু বিস্তর বই পড়ে।”
“তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি
সুকুদি,” লজ্জায় লাল হয়ে বললেন শ্বেতা। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টাতেই শাওনের দিকে চেয়ে
বললেন, “খেয়ে নাও শানু। বসে ভাইয়ের সাথে গল্পটল্প করো খানিক। আমি তোমাদের জন্যে
একটু হাল্কা টিফিনের ব্যবস্থা করি।”
“এক্কেবারে নয়,” সুকন্যা
বললেন, “কিচ্ছু খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্তের দরকার নেই ভাই। বেশিক্ষণ থাকব না আমরা। সে
দু’টো লোক বাড়িতে বসে আছে। একা সুছন্দা কী করে সামাল দেবে কে জানে।
আমার কত্তা যা পেটুক। তা, গুহদাকে দেখছি না যে, গেলেন
কোথায়?”
“আসছে আসছে। কাল নাইট ছিল।
বেলায় ঘুম থেকে উঠেছে। এসে পড়বে এইবার,” বলেই পরদা দেওয়া ভেতরের ঘরের দিকে চাইলেন
শ্বেতা, “কই গো, হল তোমার?”
“হো গয়া। আমি রেডি। ওনাদের
বাইরের ঘরেই বসিয়ে রাখবে ভেবেছ নাকি? ভেতরে নিয়ে এস ওনাদের,” বেশ ভারি কন্ঠস্বরে
লঘু গলায় বলে উঠলেন গুহ আঙ্কল।
“তোমরা চা খাওয়া হয়ে গেলেই
তাহলে ভেতরের ঘরে এসো,” বলেই সোম দৌড়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ল।
শ্বেতা আন্টি মুচকি হাসলেন।
শাওনের মনে হল কী একটা যেন ঘটতে চলেছে। আন্টি সেটা জানেন, কিন্তু বলতে চাইছেন না। শাওন
আড়চোখে চাইল একবার পরিদাদুর দিকে। পরিদাদুও চাইলেন তার দিকে। মৃদু হাসলেন। তাহলে
তারই মতন পরিদাদুও কি আঁচ করছেন কিছু একটা? ভাবতে ভাবতেই চায়ের কাপটা নিচু ছোটো
টেবিলটার ওপরে নামিয়ে রেখে পরিদাদু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চল শাওন, ভেতরে যাই।”
শাওনও দাঁড়িয়ে পড়ল। শ্বেতা
আন্টি ঘরের পর্দা সরিয়ে বললেন, “আসুন।”
শমিত গুহ ঘরে একটা চেয়ারে বসেছিলেন।
পরিদাদু আর শাওনকে নিয়ে শ্বেতা ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। দু’হাত বাড়িয়ে
পরিদাদুর হাতদু’টোকে আন্তরিকভাবে জড়িয়ে নিয়ে ভারি গলায় বললেন, “প্লিজ কিছু মনে
করবেন না, আমার অনেক আগেই আপনাদের অ্যাটেন্ড করা উচিত ছিল...”
“না না, ঠিক আছে,” পরিদাদু
তাঁর কথার মাঝখানেই বলে ঊঠলেন, “মিসেস গুহ তো আপ্যায়নে সামান্যও ত্রুটি রাখেননি।
তাছাড়া সোম ছিল। ওকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে আমি তো ভীষণ খুশি।”
শাওন ঘরের চারপাশে তাকিয়ে
তাকিয়ে দেখছিল। বাইরের ঘরের থেকে এই ঘরটা একটু বড়ো। ঘরে
একটা পেল্লায় খাট। দেওয়ালের দিকে টেবিল। টেবিলে সোমের বইপত্র, কলম, পেনসিল।
টেবিলের ওপরে একটা বাঁধানো ছবি। শ্বেতা আন্টি ও শমিত আঙ্কলের। শমিত
আঙ্কল তখন আরও একটু রোগা ছিলেন। মুখের দাড়িটা অবশ্য একইরকম। চুলের ঘনত্ব এবং রঙটাও
একইরকম আছে এখনও। ঘরের আরেকদিকের দেওয়ালে কাঠের র্যাক। বাংলা ইংরেজি দু’ধরনেরই বই
সাজানো তাতে পরিপাটি করে। খাটের উল্টোদিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা স্টিলের তিন থাকের
আলমারি। সামনে কাচ দেওয়া। তার মধ্যে রকমারি শো-পিস। তাদের অধিকাংশই নানারকমের
হাতির মূর্তি। ছোটো, খুব ছোটো, মাঝারি, নানান মাপের এবং নানান উপাদানে তৈরি হাতি।
পরিদাদু খুব মন দিয়ে সেগুলো দেখছিলেন দেখে শমিত হাসলেন। বললেন, “এটা আমার একটা
অদ্ভুত হবি। যখন যেখানে গেছি সেখান থেকেই হাতি নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে। আসলে আমরা
অরিজিনালি পুব-বাংলার মানুষ। ঠাকুমার মুখে গল্প শুনেছি সেখানে আমাদের জমিদারি ছিল।
একসময় হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়াও থাকত নাকি। এখন তো চাইলেও সত্যিকারের হাতি
পুষতে পারব না। সে আর্থিক সক্ষমতা বা উপায় কিছুই নেই।
অগত্যা...” বলে দরাজ গলায় হেসে উঠলেন শমিত আঙ্কল।
“জমিদারি না থাকলেও জমিদারি
মেজাজ আর অদ্ভুত খেয়ালগুলো কিন্তু যায়নি পরিকাকু,” শ্বেতা বিছানায় হেলান দিয়ে
দাঁড়িয়ে বললেন, “আর তার জন্যে জ্বলে মরতে হয় আমাকেই।”
সুকুমাসি হেসে উঠলেন তাঁর
কথায়।
পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনার আর ভাইবোনেরা...”
“আমার এক দিদি। নিউ জার্সিতে
সেটল করেছে। জামাইবাবুর সাথে দেশ ছেড়েছে প্রায় বছর কুড়ি। তাই না গো?” বলে শ্বেতা
আন্টির দিকে চাইলেন তিনি। তারপর
উত্তরের অপেক্ষা না করে বললেন, “আর এক ভাই আমার। সিঁথির মোড়ে থাকে। সে শিল্পী
মানুষ। চাকরিবাকরি করেনি। জমিদারি মেজাজটা বলতে গেলে সে-ই ধরে রেখেছে। খামখেয়ালি,
হুল্লোড়বাজ...”
“এটাও বল যে অমিত খানিকটা
বেহিসেবিও বটে,” শ্বেতা যোগ করলেন।
“দেখো, শিল্পী মানুষেরা অমন
একটু হয়,” শমিত হেসে বলেন, “সারাক্ষণ লাভক্ষতির যোগ বিয়োগ কষলে কি মাথায় আর
ক্রিয়েটিভ কিছু থাকে?”
“অমিতবাবু কি ছবি আঁকেন, নাকি
লেখক?” সুকন্যা জিজ্ঞেস করলেন।
“অভিনেতা। ওদের থিয়েটারের
গ্রুপ আছে। গ্রুপটার নাম আছে ভালোই। প্রায়ই এখানে ওখানে শো করার জন্যে ডাক পায়।
আমরাও দেখতে গিয়েছিলাম একবার,” শ্বেতা বলে ওঠেন।
“গ্রুপটার নাম?” পরিদাদু
জিজ্ঞেস করলেন।
“কী যেন একটা মহল। মনে পড়ছে
না ঠিক,” শমিত বললেন।
শ্বেতা তাড়া দিলেন, “আপনারা
বসে গল্প করুন। আমি একটু লুচি ভেজে আনি।”
বলেই দরজা দিয়ে ভেতরের
বারান্দায় বেরোলেন তিনি। বারান্দার একদিকে রান্নাঘর। অপর দিকে আর একটা ঘর বানিয়ে
নেওয়া হয়েছে প্লাইউডের দেওয়াল তুলে। পরিদাদু আর শাওনকে কোয়ার্টার ঘুরিয়ে দেখাতে
দেখাতে শমিত আঙ্কল বললেন, “রেলের এই কোয়ার্টারগুলো তো খুব স্পেসিয়াস না।
কাজেই একটা মেকশিফট বন্দোবস্ত রেখেছি। গেস্টরুম বলতে পারেন এটা। একটা তক্তপোশ রাখা
আছে। প্রয়োজনে জনদুই শুয়ে পড়তে পারবে। কেউ বাড়িতে এলে কাজে লেগে যায়। এমনিতে
ফাঁকাই থাকে। আমরা তিনজনেই তো ও ঘরের বড়ো খাটেই শুয়ে পড়ি একসাথে।”
পরিদাদু ঘরটায় ঢুকে দেখে এলেন
একবার। তারিফের ভঙ্গীতে বললেন, “ঘরটা ভালোই তো।”
বারান্দার সামনে বেশ লম্বা উঠোন
পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। উঠোনের অপর প্রান্তে কলঘর, টয়লেট এইসব। একটা বড়ো চৌবাচ্চা আছে।
শমিত বললেন, “দিনে দু’বার করে জল আসে। ঘন্টাদুই ধরে। জলের কোনও অসুবিধা নেই এখানে।”
“কী যে করো বাপু বুঝি না!” রান্নাঘর
থেকে শ্বেতা বলে ওঠেন, “ঘরে বসাও না ওঁদের। কী তখন থেকে কলঘর আর বাথরুম দেখাচ্ছ! সত্যি,
তোমায় নিয়ে আর পারি না।”
শমিত লাজুক মুখে হাসলেন।
বললেন, “চলুন। ঘরে গিয়ে বসি।”
ঘরে এসে বসে পরিদাদু আবার সেই
কাচের শো-কেসের দিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে। তারপর
একসময় উঠে কাছে এগিয়ে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন হাতিগুলো। তারপর আপন মনেই বলে
উঠলেন, “অপূর্ব! সত্যি দারুণ কালেকশন আপনার।”
শমিত হাসলেন। খুব পরিতৃপ্তির
হাসি। পরিদাদু আবার বললেন, “এর মধ্যে কিছু হাতি আছে যেগুলো তো বেশ কস্টলি। যেমন
ধরুন এই সেটটা। এটা তো সম্ভবত রাজস্থান থেকে আনা। এই
যে, পিঠে রুপোর ঝালর পাতা।”
“হ্যাঁ,” শমিত ছোট্ট উত্তর
দিলেন।
“আর এই যে ছোট্ট হাতিদুটো,
এগুলো তো মনে হচ্ছে আইভরি।”
“হুঁ,” শমিত নয়, হাতে থালায়
করে লুচি তরকারি নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শ্বেতা বললেন, “এটা কিন্তু খুব পুরনো।
আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি বলতে পারেন। যদিও এটা একেবারেই আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার,
তবুও আপনাদের বলতে বাধা নেই। বাবা মা
চলে যাওয়ার পরে সিঁথির বাড়ির নিচের দু’টো ঘর ছাড়া পুরো বাড়িটাই ভাইকেই দিয়ে দিল
যখন ও, পারিবারিক স্মৃতি হিসেবে এই হাতির সেট আর সঙ্গে এই কষ্টিপাথরের গণেশমূর্তিটাকেই
শুধু সঙ্গে এনেছিল।” বলে কাচের আলমারির মাঝের তাকে এক্কেবারে
মধ্যিখানে রাখা ফুট দেড়েক উচ্চতার আড় হয়ে গদায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গণেশমূর্তিটার
দিকে আঙুল বাড়ালেন শ্বেতা।
“মূর্তিটা ভারী সুন্দর,” বলে
খানিকক্ষণ একমনে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন পরিদাদু। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, “কিন্তু
আইভরির হাতি আরও একটা ছিল যে! সেটা কোথায় গেল?”
“মানে?” চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে
উঠলেন শমিত।
“মানে এখানে তো তিনটে হাতি
ছিল পর পর,” পরিদাদু বললেন আবার, “কিন্তু দু’টো দেখতে পাচ্ছি যে।”
“এখানে যে তিনটে হাতি ছিল
তুমি কী করে জানলে পরিদাদু?” সৌম্য অবাক চোখে তাঁর দিকে চেয়ে বলল।
শ্বেতা মিট মিট করে হাসছেন
তখন। শাওন সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। শ্বেতা আন্টি হাসছেন কেন? তার মানে উনি কি
ব্যাপারটা জানেন? পরিদাদুও হাসলেন। শ্বেতার হাসিটা দেখতে পেয়েছেন তিনিও। সোমের
মাথার চুলগুলো হাতের আঙুল দিয়ে এলোমেলো করে দিতে দিতে তিনি বললেন, “আমার পরীক্ষা
নেবার ব্যবস্থা করেছিলে বুঝি সোমবাবু?”
সৌম্য মাথা নিচু করল। মুখে
লাজুক হাসি।
“কিন্তু কী করে বুঝলেন বলুন
তো আপনি? আমরা তো ভেবেছিলাম একটু পরে আমরাই হঠাৎ ওটা আবিষ্কার করার নাটক করে আপনার
কাছে রিকোয়েস্ট করব হারানো হাতিটাকে খুঁজে দেবার জন্যে,” শমিত বলে উঠলেন লঘু গলায়,
“আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই! নাটকের পুরো স্ক্রিপ্টটাই গুলিয়ে দিলেন! আমরা তো নিজেদের
মুখস্থ করা পার্ট গুলিয়ে ফেলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি এখন।”
পরিদাদু হাসলেন। ধীর
গলায় বললেন, “এর মধ্যে তো কোনও ম্যাজিক নেই মিস্টার গুহ। এর জন্যে গোয়েন্দা বা
পুলিশ হবারও দরকার নেই। আর সত্যি বলতে কি আমি তেমন দরের কেউকেটা কেউ নইও। আপনাদের
মতনই সাধারণ মানুষ একজন। তবে আমি যা দেখি একটু খুঁটিয়ে দেখি। দেখি মন দিয়ে। কাজেই
অন্য অনেকের সহজে যা চোখে পড়ে না, আমার দুম করে চোখে পড়ে যায় তা। এই যেমন এখানে,
দেখুন হাল্কা ধুলোর আস্তরণ জমেছে কাচের আলমারির মধ্যেও। সেখানে ওই দু’টো হাতির
সজ্জা-রীতির সাথে তাল মিলিয়ে চারটি খুব ছোট্ট ছোট্ট গোলচে দাগ রয়েছে। মানে ওই
জায়গাটায় ধুলো পড়েনি। দাগগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় ওগুলো এই হাতিদু’টোরই
আর একটি সঙ্গী। এটা একটা সেট।”
“ধরে ফেলেছে, পরিদাদু ধরে
ফেলেছে,” বলে হাততালি দিয়ে উঠল সোম, “আমি ঠিক বলেছিলাম, পরিদাদুকে হারানো অত সহজ
নয়।”
“তা, আমার এই পরীক্ষা নেবার
বুদ্ধিটা কার?” পরিদাদু জিজ্ঞেস করেন।
“কার আবার!” আর একপ্রস্থ গরম
লুচি থালায় করে নিয়ে এসে বলে ওঠেন শ্বেতা, “এই যে, বাপ আর ছেলে।”
“তুমিও তো দলে ছিলে,” সোম
বলে, “তোমার প্ল্যানেই তো...”
“আরেকটা লুচি দিই পরিকাকু
আপনাকে?” সোমের কথার মাঝখানেই শ্বেতা বলে ওঠেন, “আর শানু, তোমার কী লাগবে?”
“আজ না। আবার কাল হবে’খন,”
পরিদাদু বলে ওঠেন, “নাটকটা আজ শেষ করলাম না কিন্তু। কাল সুছন্দা অরুণাংশু আর রণিত
সকলকে নিয়েই আসব আর একবার। আপনারা সকলেই থাকবেন কিন্তু কাল। সত্যি
সত্যিই সক্কলে। না হলে মজাটা মাঠে মারা যাবে কিন্তু। আমার লস নেই তেমন, কিন্তু
আপনাদেরই হাত কামড়াতে হতে পারে মিসেস গুহ।”
“মানে?” এবার শ্বেতা আর শমিত
দু’জনেই অবাক।
“মানেটা কালকের জন্যে তোলা
থাক না,” পরিদাদু মুচকি হাসেন, “আপনারা না রহস্য গল্প তৈরি করতে চাইছিলেন মিস্টার
গুহ? আপনিই বলুন, একমুহূর্তে পুরো রহস্যটা ফুরিয়ে গেলে কারও ভালো লাগে?”
আজ বসা হয়েছে ভেতরের বারান্দায়।
মস্ত একটা সতরঞ্চি বিছিয়ে। সন্ধে পেরিয়ে গেছে। আকাশে গোল চাঁদ উঠেছে আজ। উঠোনের
একপাশে যে দিশি জামগাছটা, তার মাথার ওপরে চাঁদটা ঝুলছে এখন। গরম
নেই। সিলিং ফ্যানের হাওয়ার সাথে পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়া অগোছালো বাতাস মিলেমিশে
যাচ্ছে।
কাল রাতে বিছানায় শুয়ে পরিদাদুকে
কতবার জিজ্ঞেস করেছে শাওন, “পরিদাদু, কী ব্যাপার বলো তো? কী একটা রহস্য নিশ্চিত
বুঝেও চুপ করে আছো তুমি!”
“খটকা, শাওনবাবু, খটকা। সঙ্গে
একটা লুকোচুরি খেলাও জড়িয়ে আছে। ঠিক আছে, দেখা যাক, বুদ্ধির খেলায় পরিমল
চাটুজ্জেকে আন্ডারএস্টিমেট করছেন যিনি তিনি শেষপর্যন্ত জিততে পারেন কি না।”
নড়েচড়ে বসে শাওন, “তোমার
বুদ্ধিকে আন্ডারএস্টিমেট কে করছে পরিদাদু?”
“আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। তুইও
ঘুমিয়ে পড় শানু। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে আমায়। কাজ আছে কতকগুলো। সে কাজগুলো সেরে
নিতে না পারলে কাল সন্ধেবেলা বেইজ্জত হয়ে যেতে পারি শ্বেতার কাছে। কাজেই আমায় আর
একদম বকাসনি বলে দিলাম। রাতে ঘুম ঠিক না হলে আজকাল আমার মাথা ঠিকমতন কাজ করে না,”
বলে সত্যিই অন্যপাশ ফিরে বেমালুম ঘুমিয়ে পড়লেন পরিদাদু। শাওন একা একাই ভেবেছে খানিকক্ষণ
কী ঘটতে চলেছে পরেরদিন। কিন্তু ভেবে কোনও কূলকিনারা সে করতে পারেনি। একসময় ঘুমিয়ে
পড়েছে নিজেও।
সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিদাদুকে
দেখতে পায়নি শাওন। রণিতমেসো বললেন, “উনি বেরিয়েছেন। বললেন, সকালের ফ্রেশ হাওয়ায়
একটু হাঁটাচলা করলে শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগে।”
কাল রণিতমেসোর ছুটি ছিল। আরও
দিন তিনেক ছুটি ম্যানেজ করেছেন তিনি। বলেছেন এ ক’দিন শাওনদের গাইড হয়ে বেনারস
ঘোরাবেন তিনি। পরিদাদু আজ দিনটা বাদ দিতে বলেছেন। আজ সন্ধেয় শ্বেতা আন্টির বাড়ি সকলের
জমায়েত। কাল থেকে শুধুই বেড়ানো।
সকলের মুখেই কেমন একটা যেন
চাপা অস্বস্তি আর কৌতূহল। পরিদাদু ঠিক কী বলতে চাইছেন আজ এখানে সকলকে জড়ো করে? সুকুমাসি
আর শ্বেতা আন্টি চা দিলেন সকলকে। চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে সকলের মুখের ওপরে
আলতো নজর বুলিয়ে নিলেন একবার পরিদাদু। তারপর শ্বেতা আন্টির দিকে চেয়ে বললেন, “আমি
যে বলেছিলাম, আপনাদের সকলকে থাকতে। বিশ্বাস করুন, থাকাটা জরুরি।”
“মানে?” শ্বেতা আন্টি অবাক
গলায় বললেন, “আমরা তো সকলেই আছি। ও, সোম, আমি...”
“উঁহু, উঁহু,” দু’দিকে মাথা
নেড়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন পরিদাদু, “শমিতবাবু তো নেই। অথচ ওনার থাকাটা খুবই
দরকার আজ। কালও তো উনি লেট শিফটে অফিস করেছেন। আজ তো ওনার ডে অফ। আমি খবর নিয়েছি।
উনি কি বাড়িতেই আছেন, নাকি বাইরে কোথাও? বাইরে থাকলে নিশ্চিত দূরে কোথাও যাননি। ফোন
করুন ওঁকে শ্বেতা।”
ভয়ানক অবাক হয়ে গেল শাওন।
পরিদাদুর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ওই তো বসে আছেন শমিত আঙ্কল।
শমিত হো হো করে হেসে উঠলেন।
পরিদাদুর দিকে চেয়ে হাল্কা গলায় বললেন, “না হয় কাল আপনাকে আমরা একটু বোকা বানানোর
চেষ্টা করেছিলাম পরিমলবাবু, তাই বলে আমি জলজ্যান্ত মানুষটা বসে আছি অথচ আমাকে
অস্বীকার করছেন আপনি! এ কীরকম কথা মশাই? আমি যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়ে যাচ্ছি
এবার আপনার পাল্লায় পড়ে।”
“আমি কালই বলেছিলাম অমিতবাবু,
আমার দেখাটা আর পাঁচজনের চেয়ে একটু আলাদা। আপনি শমিতবাবুর যমজ ভাই। দেখতে প্রায়
একরকম। কাজেই নকল দাড়ি আর দাদার মতন চুলের স্টাইলে শমিতবাবুর সাথে আপনাকে আলাদা
করা সত্যি সত্যিই প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ওই যে বিচ্ছিরি একটা শব্দ থেকেই গেল,
‘প্রায়’। আর সেইজন্যেই যতই নিখুঁত মেক আপ নিন
না কেন, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যে সহজ নয়...”
“কিন্তু আমি নিজেই তো এক্কেবারে
বুঝিনি,” সুকুমাসি ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠলেন।
“বোঝার কথা নয়,” পরিদাদু
হাসলেন, “অমিতবাবু পেশাদার অভিনেতা। মেক আপের হাতও বেশ পাকা। কিন্তু ওই যে কাল
বলছিলাম, অবসার্ভেশনে সামান্য ত্রুটি থেকে গিয়েছিল আপনার। অথবা ব্যাপারটা জেনেও
হয়তো গুরুত্ব দেননি আপনি।”
“কী পরিকাকু?” সুছন্দা
জিজ্ঞেস করলেন অবাক হয়ে।
“একটা তিল,” পরিকাকু আবার
হাসলেন।
“তিল?” অরুণাংশু বলে উঠলেন।
“হ্যাঁ,” পরিদাদু বললেন, “ওই ঘরে
শমিতবাবু আর শ্বেতার একটি ভারী সুন্দর বাঁধানো ছবি আছে। তাতে দেখলাম শমিতবাবুর
নাকের ডগায় একটা উজ্জ্বল কালো তিল। অথচ এনার সাথে আলাপ করার সময় সেটা দেখলাম না।
প্রথমে মনে হল ছবিটায় হয়তো কোনও দাগ-টাগ... পরক্ষণেই মনে পড়ল, সোমের হাতে থাকা
মোবাইলে দেখা ছবিগুলোর কথা। আমি সতর্ক হলাম। বুঝলাম কী একটা যেন গন্ডগোল আছে
ব্যাপারটার মধ্যে। আমাকে কেউ ইচ্ছে করে ঠকাতে চাইছে। মজা
করতে চাইছে আমার সঙ্গে। আরও শিওর হবার জন্যে বারান্দার ওই ঘরে ঢুকলাম। স্পষ্ট
চিহ্ন পেলাম রাতে সেখানে কেউ শুয়েছিল। তাছাড়া শ্বেতার সাথে নকল শমিতের কথোপকথনের
ধরনেও খটকা লাগল। যতই গট আপ নাটক হোক, হাজার হোক দেওর
আর বৌদি তো।”
“কাকু তুমি হেরো, কাকু তুমি
হেরো। মা তুমি হেরো, মা তুমি হেরো। পরিদাদু
ঠিক ধরে ফেলেছে সব,” বলে লাফিয়ে উঠল সৌম্য।
পরিদাদু থামলেন। একটু সময় চুপ
করে থাকলেন। তারপর বললেন, “আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি। নাটকটায় পর্দা পড়তে আরও একটু
বাকি রয়ে গেছে। আর আমি চাই সেই শেষ কথাটুকু শমিতবাবুর সামনে হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
শ্বেতা, প্লিজ ওঁকে ফোন করে ডেকে নিন আপনি।”
শমিত এলেন মিনিট পনেরোর
মধ্যেই। কাছেই এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন দুপুরের পর থেকে। পরিদাদু দু’হাত জোড় করে
নমস্কার করলেন তাঁকে। তিনিও প্রতিনমস্কার করলেন। এতক্ষণের কথা শুনে খুব হাসলেন
একচোট। বললেন, “তাহলে সোমের তো খুব আনন্দ। ও তো বলেই দিয়েছিল পরিদাদুকে আমরা
হারাতে পারব না। যাক, আমরাই হেরেছি। আনন্দের সঙ্গেই সে হার আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি।
এখন শ্বেতা, সেই আনন্দে একরাউন্ড কফি হয়ে যাক।”
এ কথায় হই হই করে উঠল সকলে।
কিন্তু পরিদাদু খুব গম্ভীর মুখ করে বললেন, “আমি এখন যে কথাটা বলব সেটা কিন্তু খুব
হাসির কথা নয় শমিতবাবু। যদিও বিষয়টি একেবারেই পারিবারিক, তবুও একটা খেলায় আপনারাই
যখন আমায় জড়িয়ে দিয়েছেন তাই শেষপর্যন্ত অংশগ্রহণ আমায় করতেই হল। দয়া করে কিছু মনে
করবেন না।”
“কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি
এতটা সিরিয়াস হয়ে গেলেন কেন?” শমিত জিজ্ঞেস করলেন চোখ সরু করে।
“দেখুন, এমন একটা ঘটনা ঘটেছে
এই খেলার মধ্যে যেটা কিন্তু খেলা নয়, সত্যি।”
“বুঝলাম না।”
“আপনার শো-কেসে রাখা আপনাদের
পূর্বপুরুষের কষ্টিপাথরের গণেশমূর্তিটি কিন্তু বদলে গেছে।”
“হোয়াট?” উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে
পড়েছেন শমিত, “কে বদলালো এটা, আর কেন?”
“এ বিষয়টা আপনি একটু পরিষ্কার
করুন না অমিতবাবু,” পরিদাদু খুব ঠান্ডা গলায় অমিতের দিকে চেয়ে বললেন।
“আমার তো কই মনেই হচ্ছে না
ওটা বদল হয়েছে। যেমন ছিল তেমনই তো রয়েছে ওটা,” অমিত বললেন বিরক্তির সঙ্গে।
পরিদাদু হাসলেন, “স্বাভাবিক।
আপনি নিজেই যখন ওটা বদল করেছেন তখন আপনার চোখে বদলটা ধরা না পড়াই স্বাভাবিক।”
“এবারে আপনি কিন্তু সীমা
ছাড়াচ্ছেন পরিমলবাবু,” গর্জন করে উঠলেন অমিতবাবু, “আমরা স্রেফ মজা করার জন্যে একটা
খেলা তৈরি করেছিলাম সবাই মিলে আনন্দ করব বলে। কিন্তু আপনি সেই আনন্দটাকে ভয়ংকর
একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক, সেখানে
চিড় ধরে যেতে পারে আপনার এমন বিশ্রী ঠাট্টার ফলে।”
“আমি তো ঠাট্টা করছি না
অমিতবাবু,” স্থির গলায় বলে উঠলেন পরিদাদু, “আমি শুধু একটা প্রাচীন পারিবারিক
ঐতিহ্যের স্মারককে বাঁচাতে চাইছি।”
“আপনি পাগল হয়ে গেছেন।”
“না অমিতবাবু,” পরিদাদু কড়া
চোখে চাইলেন অমিত গুহের দিকে, “আপনার থিয়েটারের দল যেটার নাম কাল ইচ্ছে করে ভুলে
যাওয়ার ভান করলেন, সেই বন্ধুসঙ্ঘ তো ইদানিং ভেঙে গেছে। পয়সার অভাবে ভালো প্রোডাকশন
নামাতেও পারছেন না আর আপনারা। গত দেড় বছরে একটা কল শোতেও ডাক পড়েনি আপনাদের।
আমি সব খবর নিয়েছি অমিতবাবু। আপনিই বলুন, আমি কি ভুল বলছি?”
“না,” মাথা নামান অমিত গুহ,
“কিন্তু এর সাথে এই গণেশমূর্তির কী সংযোগ?”
“সংযোগ নেই!” পরিদাদু হাসলেন,
“তাহলে কুমোরটুলির সুবীর পালকে দিয়ে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে এই কালো পাথরের নকল গণেশমূর্তিটা
বানাতে গেলেন কেন, আর এখানে এসে আসল মূর্তি নিজের সুটকেসে ভরে সেই নকল মূর্তি
আলমারিতে রাখতেই বা গেলেন কেন?”
“আপনি কী করে জানলেন!” ধসে
পড়া গলায় বলে উঠলেন অমিত গুহ।
“জানতে হয় অমিতবাবু। সন্দেহ
হলে বিভিন্ন জায়গায় লোক লাগিয়ে খোঁজখবর করাতে হয়। নইলে সত্যিটা জানব কেমন করে
বলুন। আর আমার এ এক বিচ্ছিরি নেশা জানেন তো, কোথাও খটকা লাগলে সত্যিটা না জানা
পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাই না। কাজেই যেই নজরে এল মূর্তিটা নকল...”
“কী করে নজরে এল?”
“এই ক্রেডিটটাও শ্রীমান
সৌম্যর। ও একটা ছবি দেখাচ্ছিল আমায়। নিজের। এই আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে তোলা সেলফি।
সেখানে গণেশের মূর্তিটায় দেখলাম দু’চোখের মাঝখান থেকে শুঁড় বরাবর একটা ফাটা দাগ।
অথচ এখানে...”
“আমি ভেবেছিলাম সেই তো পড়েই
আছে মূর্তিটা এখানে শুধুমুধু। অমন শো-পিস একখানা গড়ে দিয়ে ওটা বেচে দিই। খোঁজ
নিয়েছিলাম। ভালোই দাম পেতাম ওটার। আমার দলটাকে আবার দাঁড় করানোর জন্যে সত্যিই কিছু
টাকা দরকার ছিল আমার,” বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন অমিতবাবু। বার বার বলতে
লাগলেন, “সরি দাদা। বৌদি, প্লিজ ক্ষমা করে দাও আমায়। সোমের কাছে কত ছোটো হয়ে গেলাম
আজ। ও কী ধারণা করল আজ আমার সম্পর্কে!”
শাওনের খারাপ লাগছিল।
সুছন্দারও কষ্ট হচ্ছিল মনে মনে। অরুণাংশু
ফিসফিস করে বলছিলেন, “পরি এটা সকলের সামনে না করলেই পারত।”
হঠাৎ শমিত গুহ উঠে দাঁড়িয়ে
দু’হাত ধরে জড়িয়ে ধরলেন ভাইকে। তারপর গাঢ় গলায় বলে উঠলেন, “কী বোকা রে তুই! এত বড়ো
হয়েও সেই ছিঁচকাঁদুনেই রয়ে গেলি! আরে, আমরা সবাই পরীক্ষা নিয়েছি পরিমলবাবুর। তুইও
নিয়েছিস। এই পরীক্ষাটা সত্যি একটু কঠিন ছিল। বলতে কি, এটাই ছিল ঠিকঠাক পরীক্ষা। সে
পরীক্ষায় পরিমলবাবু শুধু পাশই করেননি, একেবারে ডিস্টিংশন পেয়েছেন। কাজেই
পরবর্তীতেও তাঁর সিদ্ধিলাভের কামনায় সুবীর পালের হাতে গড়া এই অসামান্য গণেশমূর্তিটি
আজ আমরা ওনাকে উপহার হিসেবে দিতে চাই। তুই পুরনো মূর্তিটা বের করে ঠিক জায়গায় রেখে
দে। মনে রাখিস, পুরনো সম্পর্কের মতন পুরনো কিছু স্মৃতি আর স্মারককেও যত্ন করে
রক্ষা করতে হয়। নে, উঠে পড় হতভাগা। পরিমলবাবুর উপহারটা নিজহাতে তুলে দে ওনার হাতে।
আর আমিও কথা দিলাম, তোর নাটকের দলকে নতুন করে বাঁচানোর দায়িত্ব আমি নিলাম।”
পরিবেশটা থমথমে হয়ে গিয়েছিল।
শমিতবাবুর কথায় সেই গুমোট ভাবটা কেটে গেল অনেকটাই। তবু যেটুকু ছিল তা কাটাতেই
বোধহয় উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন শমিত গুহ, “শ্বেতা, মাইন্ড ইট, এই রিমার্কেবল দিনটা
আজ আমরা সবাই মিলে সেলিব্রেট করব কিন্তু। কাউকে ছাড়বে না। এবার নির্ভেজাল আড্ডা
হবে খানিকক্ষণ। আজ সকলে ডিনার করব একসাথে এবং সেটা হবে এই বাড়িতেই।”
_____
ছবিঃ সম্বুদ্ধ বিশী
No comments:
Post a Comment