
সে ছিল চৈত্রাবসান
ছেলেবেলার কথা
অপূর্ব দত্ত
অভিধান অনুযায়ী ‘পাঠশালা’ শব্দটার
যে অর্থ সে অর্থে পাঠশালায় পড়ার সুযোগ বা সৌভাগ্য কোনওটাই আমার হয়নি। ‘পাঠশালা’
বলতে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় বা চতুষ্পাঠী ইত্যাদিকে বোঝায়। তখনও হায়ার
সেকেন্ডারি পাঠক্রম চালু হয়নি, দশ ক্লাসের পর স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দিতে হত। জন্মেছিলাম
রানাঘাটে, স্বাধীন ভারতের বয়স তখন চার-ও পেরোয়নি। নদীয়া জেলার
দুটো মহকুমা শহরের মধ্যে একটা হল রানাঘাট। দেশভাগের আগে এই নদীয়াতে মহকুমার সংখ্যা
ছিল পাঁচ। দেশভাগের ফলে পাঁচ মহকুমার মধ্যে কুষ্ঠিয়া, মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা চলে
গেল পূর্ব পাকিস্তানে, আর কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট থেকে গেল পশ্চিম বাংলায়। অনেক দিক
থেকেই রানাঘাট বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। এমনিতেই নদীয়ার
ইতিবৃত্ত অনেক প্রাচীন এবং ঘটনাবহুল। চৈতন্যদেবের পীঠভূমি নবদ্বীপ, কবি কৃত্তিবাসের
জন্মভূমি ফুলিয়া, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যপাট কৃষ্ণনগর - এই সব ইতিহাসের সঙ্গে
যুক্ত হয়ে আছে রানাঘাটের জমিদার পালচৌধুরীদের নাম। এছাড়া আরও অনেক মনীষীর
জন্মস্থান এই নদীয়া। সে অর্থে রানাঘাটকে ঠিক গ্রাম-গঞ্জ বলা যেত না, মফস্বল শহর
হিসেবেই প্রসিদ্ধি ছিল। তার অন্য কারণও ছিল, কলকাতা থেকে নদীয়া, মুর্শিদাবাদ তথা সমগ্র উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের
মাধ্যম ছিল রানাঘাটের প্রান্ত ধরে চলে যাওয়া ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক, যা এখনও সমান
ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া দেশভাগের আগে পর্যন্ত রেলপথে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার
জন্য ‘পাকিস্তান মেল’ যাতায়াত করত এই রানাঘাট স্টেশনের ওপর দিয়ে। অবশ্য তিন-চার
মাইল ব্যাসার্ধের এই জনপদের চারদিক ঘিরে কিন্তু ছিল মাইলের পর মাইল গ্রাম আর চাষের
জমি। পশ্চিম প্রান্তে চূর্ণী নদীর ওপারে
আঁশতলা গ্রাম। ঘরে ঘরে হাতে টানা তাঁত আর চাষবাসই ছিল গ্রামবাসীদের জীবিকা।
পূর্বদিকে রেললাইনের ওপারে নাশরা কলোনি এবং কুপার্স ক্যাম্প ছিল দেশভাগের পর পূর্ব
পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জায়গা। উত্তর এবং দক্ষিণেও গ্রামের
পর গ্রাম ছিল চাষের জমি আর মেটে ঘর।
আমি যখন স্কুলে ভর্তি হই
তখন রানাঘাট শহরেই পাঁচ-ছটা হাইস্কুল। তার মধ্যে সব চেয়ে পুরোনো ছিল রানাঘাটের
জমিদার পালচৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত পালচৌধুরী বিদ্যালয়। সে স্কুলের বয়স এখন
দেড়শ বছরেরও বেশি। আমার বাবাও ছিলেন এই স্কুলের ছাত্র। এখনকার মত নার্সারি, বা
কেজি- ওয়ান কেজি টু-র প্রচলন হয়নি তখন। ছেলেমেয়েরা ওয়ান, টু বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরাসরি থ্রিতে ভর্তি হত। প্রাইমারি স্কুল যে
একেবারে ছিল না তা নয়, তবে যেহেতু আমার ওপরের দাদা দিদিরা সবাই বাড়ির লাগোয়া এই
স্কুলেই পড়াশোনা করেছে তাই আমিও কোনও ব্যতিক্রম ছিলাম না। ক্লাস ফোর অবধি ছেলে আর
মেয়ে একসঙ্গে পড়ত। ফাইভ থেকে মেয়েরা চলে যেত শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট
হেমনলিনী বা ব্রজবালা বালিকা বিদ্যালয়ে। তা ছাড়া প্রাইমারির পরে কো-এডুকেশানের
প্রথা তখনও চালু হয়নি।
একেবারে ছোটোবয়সের অনেক
স্মৃতি আমার মনে গেঁথে থাকলেও ঠিক কোন দিন প্রথম স্কুলে গিয়েছিলাম অনেক চেষ্টা
করেও আজ পর্যন্ত মনে আনতে পারিনি, অথচ সেই সময়ের অনেক ঘটনার সালতামামি হিসেব এই
বয়সে পৌঁছে যখন করতে বসি তখন ভাবলে অবাক হয়ে যাই
যে এর মধ্যে অনেক ঘটনাই ঘটেছে আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে। এমনকি আমার তিন সাড়ে
তিন বছর বয়সের সময়কার কিছু কথাও এখনও স্পষ্ট মনে আছে। যেমন কার একটা বিয়ের দিন যেন
উঠোনে ভিয়েন বসেছিল, কিংবা কোনও এক ঝড়-বৃষ্টির বিকেলে গোপালনগর থেকে বাবার ন’মামা
এসেছিলেন আর আমাকে ‘লিলি’ কোম্পানির হাতি-ঘোড়া বিস্কুটের প্যাকেট দিয়েছিলেন।
স্কুলের প্রথম দিনটার কথা মনে না থাকলেও প্রথম বছরের অনেক ঘটনাই মনে আছে।
দশ ভাই-বোনের মধ্যে আমি
ছিলাম ষষ্ঠ এবং ভাইদের মধ্যে তৃতীয়। বাড়িতে মার কাছে আমাদের ইংরাজি এবং বাংলা
অক্ষর পরিচয় সহ প্রাথমিক পাঠের অনেকটাই শেখা হয়ে যেত। ফলে আমরা পাঁচ ভাই-ই ওয়ানের
পরিবর্তে সরাসরি টু-য়ে ভর্তি হয়েছি পাঁচ বছর বয়সে। আমি আবার পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার
সাড়ে তিন মাস আগেই টু-য়ে ভর্তি হয়েছি। তখন স্কুলের বছর শুরু হত জানুয়ারি মাস থেকে,
এখনকার মত মার্চ-এপ্রিল থেকে নয়। আমার জন্ম যেহেতু এপ্রিলে (চৈত্র সংক্রান্তির
আগের দিন, নীল পুজোর দিন ভোরে) সেহেতু জানুয়ারিতে আমার পাঁচ পূর্ণ হয়নি।
সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার জন্ম-তারিখ ০৩ জানুয়ারি ১৯৫১। অর্থাৎ আমার সাড়ে তিনমাস
বয়স বাড়িয়ে খাতায় কলমে পাঁচ পূর্ণ করিয়ে ক্লাস টু-য়ে ভর্তি করা হয়েছিল। আমাদের
স্কুলটা ছিল বাড়ির খুব কাছে। সামনে দিয়ে গড়ানো রাস্তা ঝাঁপ দিয়েছে চূর্ণীর বুকে।
সেখান থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে স্কুলের মধ্যে। নদীর ধার ঘেঁষে ছিল একটা বিশাল বটগাছ,
আর তার পাশে বাঁধানো শিবমন্দির। দর্মাঘেরা টালির ছাউনি দেওয়া ঠাকুরের চায়ের দোকান।
সামনে বাঁশের বেঞ্চি পাতা, পাশাপাশি দুখানা মাটির পাতা-উনোনে ঝকঝকে কেটলি আর দুধের
ডেকচি, নানান সাইজের কাচের বয়ামে
বেকারির বিস্কুট, চানাচুরের প্যাকেট, ঝালমটর, হাতি-ঘোড়া বিস্কুট, পান কেক ইত্যাদি।
তখনকার স্থানীয় বেকারির লেড়ো বিস্কুট, ‘এস’ বিস্কুট বা টোস্ট বিস্কুটের জন্য এখনও
আমি সারা পৃথিবী খুঁজে বেড়াই। তখনও চকলেটের দিন আসেনি। লর্ডস বা মর্টন কোম্পানির
লজেন্স ছিল। এছাড়া ছিল দুধপোড়া লজেন্স, আচারের স্বাদযুক্ত টক-ঝাল লজেন্স, টিকটিকির
ডিম কিংবা লাঠি লজেন্স। লজেন্সকে তখন সবাই বলত লজেঞ্চুস। এক পয়সা দামের একটা সাড়ে
চার ভাজার প্যাকেট বা একটা পান কেক খাবার জন্য মনটা অস্থির অস্থির করত। কিন্তু তখন
ছোটোদের হাতে পয়সা দেওয়াটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ ছিল। পানের আকারে ছিল বলেই বোধ হয়
ওটাকে ‘পান কেক’ বলা হত। আসল কথাটা হয়তো ইংরাজি ‘প্যান কেক’। ওই কেকের স্বাদ যেন
আমার জীবনকে আছন্ন করে রেখেছে এই বয়সেও। অনেক নামি-দামি কেক খাওয়ার পরেও একটা পান
কেকের জন্য সমস্ত মনটা হাঁকুপাকু করে ওঠে। সে লোভ এখনও তাড়াতে পারিনি, বিশেষ করে
কেকের ওপর ওই কিসমিসটার লোভে। ভালো ভালো খাবার জিনিস বলতে তখন বিদেশি কোম্পানির
তৈরি সুদৃশ্য টিনে মোড়া জিনিস। কয়েকটা মনে পড়ছে; পলসন বাটার, লেমোনেড, আমেরিকার ‘care’ এর গুঁড়োদুধ, ওভালটিন,
ডেনমার্কের বিস্কুট কিংবা সুইজারল্যান্ডের ক্যান্ডি। অবশ্য আমাদের বাড়িতে এসব
জিনিস কস্মিন কালেও ঢোকেনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় ‘লস্কর’ বাড়ির ছেলেরা
যেরকম ‘লাঠি লজেন্স’ দেখিয়ে দেখিয়ে চুষত সেরকমই বিশ্বাস বাড়ির বা ভটচায বাড়ির
ছেলেরা আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খেত।
আমার
ঠিক ওপরের দাদা, মানে পিঠোপিঠি যাকে আমি দাদামণি বলি, আমার থেকে দু ক্লাস উঁচুতে
পড়ত। আমি যেবার ভর্তি হই ও সেবার ফোরে উঠেছে। ওই একটা বছর মা ছিল খুব নিশ্চিন্ত,
কারণ দুজনেরই সকালে স্কুল, আর ও হত আমার লোকাল গার্জেন। যদিও এমনিতে ও বেশ
শান্তশিষ্ট ছিল, বিশেষ করে চোখ –মুখের চেহারায়, তা সত্ত্বেও আমার
ব্যাপারে ওর গার্জেনগিরির কোনও সীমা-পরিসীমা ছিল না। আমার বালক বয়সের, কিশোর বয়সের
নানা ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকত দাদামণি। পরবর্তীকালে আমার অনেক ছড়া এবং গল্পের
প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার দাদামণি। একবছর পর ও ক্লাস ফাইভে উঠে দুপুরে
ইস্কুল যেতে শুরু করলে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ততদিনে আমি সাবালক, ক্লাস থ্রী।
একা একাই স্কুলে যেতে পারতাম। মোড়ের মাথা থেকে যে গড়ানে রাস্তাটা চূর্ণী নদীর দিকে
চলে গেছে সেখানেই ছিল আমাদের বাড়ি। চার মাস আগে পর্যন্ত ছিল, এখন আর নেই। বাড়ি এবং
রাস্তার মধ্যে ফুট পঞ্চাশেক একটা সরু গলি আছে, যার সামনে দাঁড়ালে পথচলতি মানুষজনকে
দেখা যেত। যেহেতু তখন খেয়া নৌকো চলত। নদীর ওপার থেকে আসা লোকজনেরাও আমাদের বাড়ির
সামনে দিয়েই যাতায়াত করত। এমনকি স্কুলের মাস্টারমশাইরাও ওই রাস্তা দিয়েই স্কুলে
যেতেন। মনে আছে, হয়তো গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছি শিকচাকা হাতে আর দূর থেকে দেখলাম
সুবোধ স্যার আসছেন, ছুট্টে লুকিয়ে পড়তাম গলির মধ্যে যাতে উনি আমাকে না দেখতে পান।
স্কুলের
কথা মনে পড়লে একই সঙ্গে মনে পড়ে আর দুজনের কথা। একজন ছিলেন হেড মাস্টারমশাই
হরিপদবাবু এবং অন্যজন হেডমাস্টার না হলেও চাল-চলন, আচার-আচরণে প্রায় হেডমাস্টার।
সে হল স্কুলের দারোয়ান রামস্বরূপদা। হরিপদ (স্যানাল)বাবুর চেহারার
মধ্যে এমন একটা সম্ভ্রম আদায় করা ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে উঠত যা তাঁকে সকলের কাছে
চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। হরিপদবাবুকে নিয়ে আমার ছোটোবেলাকার স্কুল জীবনের
স্মৃতিকাহিনী আমি বিস্তৃত লিখেছি কিশোরদের জন্য লেখা আমার একটা উপন্যাসে। এছাড়াও অন্যান্য
শিক্ষক ছিলেন শরৎ স্যার, বিজয় স্যার, সুবোধ স্যার এবং বুড়োস্যার। বুড়োস্যারের ভালো
নাম ছিল প্রবোধবাবু। পদবীটা আজ আর মনে নেই। বুড়োটে দেখাতো বলে, না প্রকৃতই ওঁর ডাক
নাম বুড়ো ছিল সেটা জানতে পারিনি। বিজয় স্যারের বাবা অমূল্যবাবু ( অমূল্যচরণ বসু)
ডে –সেকশনের শিক্ষক ছিলেন। আমি ফাইভে উঠে ওঁর কাছে পড়েছি। এদের কেউই এখন জীবিত
নেই, তবে এঁদের কথা লিখতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
স্কুলে
ভর্তির দিনটা ভালো মনে পড়ে না আগেই বলেছি। তবে আবছা মনে পড়ছে, শরৎ স্যার কিশলয়
পড়াচ্ছিলেন ক্লাসে, হঠাৎ কাঠের কড়ি-বরগার ফাঁক থেকে দুটো গোলা পায়রা উড়তে উড়তে
ঘরের মধ্যে পাক খেতে শুরু করল। উনি কাঁধের থেকে মাফলারটা নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে ‘হুউস
হুউস’ আওয়াজ করতে লাগলেন। পায়রা দুটোও লজ্জা লজ্জা মুখ করে জানলা গলে বেরিয়ে গিয়ে
ওঁকে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। ভর্তি হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই একটা
বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে গেল। অবশ্য সেটা যে বেদনাদায়ক সেটা
বুঝেছি অনেক পরে। সকালবেলায় স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেছে, সবাই ক্লাসে যাওয়ার জন্য
ব্যস্ত হয়ে ছুটছে। হঠাৎ টিচার্সরুমের সামনে স্যারদের জটলা। সকলের মুখ গম্ভীর।
এগুলো সবই আমার বড় হওয়ার পরের বোধ। দাদামণি বলল, শরৎ স্যার মারা গেছেন। স্কুলে আসার
পথে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে রাস্তায় মারা গেছেন। ওই বয়সে আমি কোনও মৃত্যু দেখিনি। দেখা
তো দূরের কথা, কাকে বলে সেটাও জানতাম না। মনে আছে রামস্বরূপদা টানা ঘণ্টা বাজিয়ে
সবাইকে বলেছিল, ‘এখোন বাড়িতে চোলে যাও, আজ কিলাস হোবে না’। কয়েকদিন পরে শরৎ
স্যারের ভাই সত্য স্যার, যিনি তখন আমার বড়দার থেকেও বোধ হয় বয়সে ছোটো ছিলেন,
শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন।
কিশলয়ের
অনেক কবিতাই আমার মুখস্থ ছিল। তখন রাতে মার কাছে শুতাম। প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গার পর
বিছানায় শুয়ে মা মুখে মুখে হারানো দিনের কবিতা বলত। ভাই-বোনদের মধ্যে আমিই ছিলাম
একনিষ্ঠ গ্রোগাসী শ্রোতা। প্রথমে মা একটা শ্লোক বলত--- ‘পরিত্রাণায় সাধূনাং
বিনাশায় দুষ্কৃতাম, ধর্মসংস্থাপনার্থায় চ সম্ভবামি যুগে যুগে...’। ভুলও হতে পারে।
যেটুকু মনে আছে লিখলাম। তারপর কবিতা একটার পর একটা - মনোমোহন
বসুর লেখা ‘যখনকার যা যে নাহি করে/ বাল্যকালে যারে আলস্যে ধরে,/ পড়িতে পড়িতে
খেলিতে চায়, / সে জন কখন বিদ্যা না পায়’। কিংবা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ‘চিরসুখীজনে
ভ্রমে কি কখন/ ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে!’ অথবা ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায়
মোমের বাতি......’ কোনওদিন আবার কালীপ্রসন্ন ঘোষের কবিতার লাইন - ‘পারিব
না এ কথাটি বলিও না আর/ কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার......’, নবকৃষ্ণ
ভট্টাচার্যের ‘মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই......’।
রবি ঠাকুরের ‘বসেছে আজ রথের তলায় স্নান যাত্রার মেলা।/ সকাল থেকে বাদল
হল, ফুরিয়ে এল বেলা......’ কিংবা ‘বসিয়া প্রভাতকালে সেতারার দূর্গভালে/
শিবাজী হেরিলা একদিন......’। এমনিভাবে পাঁচ পেরোবার আগেই আমার মনের মণিকোঠায় স্থান
করে নিয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, কামিনী
রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, প্রিয়ংবদা দেবী, সরলাবালা সরকার, গোলাম
মোস্তাফা, ফটিক বন্দোপাধ্যায়, বন্দে আলি মিঞা, গিরিজাকুমার বসুর মতো বাংলা
সাহিত্যের অধুনাবিস্মৃতপ্রায় অথচ চিরবরেণ্য লেখক-লেখিকারা। সবচেয়ে ভালোবাসতাম
(কারণ মা এই কবিতাটাই বেশি দিন বেশি করে শোনাত) কবি জীবনানন্দ দাশের মাতৃদেবী
কুসুমকুমারী দাশের ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’।

স্কুলে
বোধ হয় ফোর-ফাইভ পর্যন্ত সব ক্লাসেই ‘কিশলয়’ পাঠ্য ছিল। মা-র প্রাতঃকালীন
গৃহশিক্ষকতার দৌলতে কিশলয়ের অনেক গল্প-কবিতাই আমার জলের মতো মুখস্থ ছিল। এটা
ভাঙ্গিয়েই আমি শিক্ষকদের কাছে ছোটো থেকেই অন্য সহপাঠীদের চেয়ে একটু বেশি প্রিয়তা
লাভ করেছিলাম। মার কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস
ফোরের গণ্ডি টপকাতে না পারা। কিন্তু মা আমার শৈশব কৈশোরকে একটা বড় গাছের সঙ্গে
বেঁধে দিয়েছিল যেটা ছিঁড়ে বেরোতে প্রাণপণ চেষ্টা করেও আমি কখনও পারিনি।
বালকবয়সকেন্দ্রিক আমার অগুনতি ছড়া-গল্প-কিশোরকবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে ছড়িয়ে রয়েছে
আমার মায়ের স্পর্শ। বাহুল্য মনে হতে পারে, (প্রিয়পাঠক, আত্মপ্রচার মনে করে অপরাধ
নেবেন না) সম্প্রতি লেখা এরকম একটি দীর্ঘ কবিতার দু-একটা চরণ উদ্ধৃত করার লোভ
সংবরণ করতে পারছি নাঃ
সে ছিল
মায়ের মুখে শোনা গল্প-কথা
রঙচটা
ফিকে জলছবি,
তবু সেই
স্মৃতি তুলে রেখেছি সিন্দুকে
সেদিনের
আনন্দ ভৈরবী।
সে ছিল
চৈত্রাবসান, বাতাসে আগুন
দিনান্তে
মেঘের ছায়া নামে,
মা ঝুঁকে
রয়েছে, কোলে ‘সঞ্চয়িতা’ খোলা
ক্লান্ত
পিঠ বারান্দার থামে।
সে ছিল
স্বপ্নের ভোর, বিছানায় শুয়ে
মা শোনাত
মায়াবি কবিতা,
কুসুমকুমারী
দাসী, প্রিয়ংবদা দেবী
রামায়ণে
মনুসংহিতা।
কে কাকে
শোনাবে সেই কাব্য-গল্প-গাথা
মা আজ
নিজেই স্থির ছবি,
অক্ষরে
অক্ষরে গেঁথে পরাব যে মালা
আমি নই
সার্থক সে কবি!
ছবির
ওপরে ছবি, কত কত ছবি
বেগুনি
হলুদ সাদা কালো,
দু-চোখে
জলের স্রোত, ধুয়ে যাচ্ছে রঙ
ধীরে
ধীরে মুছে যাচ্ছে আলো।
দেয়ালে
টাঙ্গানো সেই ছবিটার গায়ে
দিনান্তের
গাঢ় ছায়া নামে,
মা ঝুঁকে
রয়েছে, কোলে ‘সঞ্চয়িতা’ খোলা
ক্লান্ত
পিঠ বারান্দার থামে।
কত
কথাই মনে পড়ছে। সত্যিই তো! ছবির ওপরে ছবি, কত কত ছবি, বেগুনি হলুদ সাদা কালো।
পিঁপড়ের মতো লাইন দিয়ে হেঁটে আসছে ঘটনা পরম্পরা। দিনান্তের ছায়া মিশে যাচ্ছে
চূর্নির জলে। ভেসে যাওয়া খেয়া নৌকোর মাঝির বেতের শরীরের কনটুর ফুটে উঠছে সাদা
ক্যানভাসে। দিবসের শেষ সূর্য তার মমতা মাখানো হাত দুটো রেখেছে কবির শিয়রে।
পালচৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের জানলার খড়খড়ি দিয়ে কবি চেয়ে আছে তার বালকবেলার রঙ ধুয়ে
যাওয়া ছবিগুলোর দিকে। ওইতো হরিপদবাবু, ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরে হাতে চক-ডাস্টার
নিয়ে ঢুকছেন ফোর বি-তে। টিচার্স রুমের সিঁড়ির সামনে সবাই দাঁড়িয়ে ‘জনগণমনঅধিনায়ক
জয় হে’ গাইছে। চোখের সামনে ঠাকুরের চা-দোকান, বুড়ো বটগাছ। তার পাশে ভাঙ্গা শিবমন্দিরের
চাতালে বসে ছিয়ানব্বই বছরের বৃদ্ধ গোকুলমালো জালে গাব মাখাচ্ছে, রামস্বরূপদা
অ্যাটেণ্ড্যান্স রেজিস্টার বগলে নিয়ে দ্রুতপায়ে হরিপদবাবুর ঘরের দিকে এগোচ্ছে।
আরও, আরও কত কত ধুলোপড়া ফিকে হয়ে যাওয়া ছবি......।
আর
মনে পড়ছে লোহার গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ ইউক্যালিপটাস গাছটাকে, যার
অবিসংবাদিত মালিক ছিল আমাদের দ্বিতীয় হেড মাস্টারমশাই, মানে দারোয়ান-কাম-
ম্যানেজার-কাম-গোটা স্কুলের মালিক রামস্বরূপদা। সেই বয়সে খুব রাগ হত যখন গাছের
তলায় অনাদরে অবহেলায় পড়ে থাকা একটা হলুদ হয়ে যাওয়া ঝুরঝুরে ইউক্যালিপটাস পাতা
লুকিয়ে কুড়োতে যেতাম বাড়ি ফিরে মাকে দেব বলে, আর তক্ষুনি কোত্থেকে চিলের মতো হাত
থেকে ছিনিয়ে নিয়ে রামস্বরূপদা বলত — ‘এই খোকা, পাতা কি মাগনা আসে? পাতায় হাত দিবে না,
রাখিয়ে দাও’। পরে অবশ্য উঁচু ক্লাসে উঠে রামস্বরূপদার সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে
গিয়েছিল।
পাঠশালার
জীবন, বালকবেলার জীবন মানে বোধ হয় অর্ধেক জীবন, এত অল্প পরিসরে তার কতটুকুই বা ধরা
যায়। তবে এখনও কাজে-অকাজে রানাঘাটে গেলে মাঝেমাঝে নদীটার কাছে গিয়ে দাঁড়াই।
খেয়ানৌকো বিদায় নিয়েছে কবেই। সে জায়গায় এখন তারের ঝুলন্ত ব্রিজ। সেই পালচৌধুরী
উচ্চ বিদ্যালয়ও আর নেই। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বিস্তৃত হয়েছে অনেক। বটগাছটা কোনও এক
ঝড়ের রাতে সমূলে উৎপাটিত হয়ে গেছে। শিবমন্দিরের শরীরে চেপেছে সাদা মার্বেলের চাদর।
চা-দোকানের ঠাকুর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে আমার ছাত্রজীবন থাকতে থাকতেই। থাকার
মধ্যে শুধু আছে ইউক্যালিপটাস গাছটা, যার তলায় শুকনো পাতা জমে আছে স্তূপাকারে, যা
এখনকার ছেলেমেয়েদের আর কোনও কাজে লাগে না।
______
Chokhe jol ene deowa lekha....
ReplyDeleteKhub bhalo laglo. Onar mato ekjan charakar o manushke amra haralam eta bhabteyi kharap lagche.
ReplyDeleteরাণাঘাট যাইনি কখনো, শুধু রেলগাড়িতে করে পার হয়েছি। তবে শহরটির সাথে, চূর্নিনদীর সাথে পরিচয় ঘটে বিভূতিভূষণের 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' পড়ে। আজ আরো ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় হল।
ReplyDeleteদারুন।
ReplyDelete