শিমলা,
কুল্লু-মনালী যাত্রার
সচিত্র ডায়রি
তাপসকিরণ রায়
ডায়রি
যখন, তখন তারিখ দিয়ে লিখে গেলে ভালো হবে।
ভিতরে যেমন লেখো - আপন কথা, গোপন কথা অথবা বারোয়ারি গালগল্পের কথা।
তারিখ
- ১৩/০৫/২০১১
আমি
আর আমার স্ত্রী যাত্রা শুরু করলাম। লটবহরের
মধ্যে হুইলবালা একটা ব্যাগ, মাঝারি পদের সুটকেস,
আর বাজারের ব্যাগের টাইপের কিন্তু বেশ পোক্ত-পুরু
কাপড়ের চেন দেওয়া ব্যাগ। একেবারে
বাজারের ব্যাগ, শুনতে কেমন যেন শোনায়।
কোথাও বের হচ্ছি, দশজন লোক দেখবে, বারোজন লোকের সঙ্গে কথা হবে।
তাই ওপরের চাকচিক্য বজায় রাখতে হবে তো!
আপাতত
আমরা দুটি প্রাণী, স্বামী-স্ত্রী। আমি ষাট বছরের বৃদ্ধ।
স্ত্রী এখনও চাকরি করেন, তাঁকে বৃদ্ধা বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। অতএব
ওই শব্দটা স্ত্রীর কাছ থেকে আড়ালে রাখতে চাইলাম।
দুটি
প্রাণী হলেও মনে আনন্দের ছোঁয়ার মত ভিতরে কিছু আছে। এ
যাত্রার সঞ্চালক সঞ্চালিকা কিন্তু আমার বড় জামাই ও মেয়ে। তাদের
আন্তরিক অনুরোধ না ফেলতে পেরে অবশেষে আনন্দের সঙ্গেই যাবার মত দিয়ে বসলাম।
কথা ছিল জামাই মেয়ে আর দুই নাতনী ওরা উড়ে যাবে দিল্লিতে।
আর আমরা? না,
উড়ে যাব না, জবলপুর থেকে সম্পর্কক্রান্তি ট্রেন
ধরব দিল্লি পৌঁছাতে।
একটু
আগেই আনন্দের ছোঁয়া, শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম।
সে আনন্দর ছোঁয়া কার ছোঁয়া বলতে পারো? আমার দুই নাতনীর। বড়
নাতনীর বয়স এগারো আর ছোট নাতনীর সাড়ে তিন। তোমাদের
মনে হতে পারে, আমার মত বৃদ্ধের আর ওদের
মত কচিকাঁচার মধ্যে কী ভাবে জমবে। তাই
না? এটা প্রকৃতির ধর্ম।
বৃদ্ধত্বের দিকে যত এগিয়ে যাওয়া যায়,
ততই শৈশবকাল যেন এগিয়ে আসতে থাকে! নাতি,
নাতনীদের তখন মনে হয় সমবয়সী। এই
দেখো না, যখন নাতি, নাতনীরা আমাদের
ঘরে আসে, মাঝে মাঝে আমি ভুলে যাই যে আমি বৃদ্ধ।
আমার মনে হয় আমি ওদের বয়সি। ওদের
সঙ্গে খেলি। ওদের সঙ্গে দৌড়াই।
ওদের মত করে ওদেরকে ভেঙচাই। কখনও
হঠাৎ নিজেকে ভুলে গিয়ে নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে নেচে উঠি। আমার
স্ত্রীর অবস্থাও অনেকটা তাই। নাতনীদের
সঙ্গে গল্প করা, ওদের খেলাধুলায় অংশ নেওয়া,
মাঝে মধ্যে এমনও হয়েছে নাতনীদের সঙ্গে নেচে চলেছি আমরা, নাচতে নাচতে কখন যে ওরা নাচ ছেড়ে চলে গেছে জানতেও পারিনি।
কিন্তু ওদের দাদু-দিদা তখনও নেচেই চলেছে। হঠাৎ
হয়ত আমার স্ত্রী জিভ কেটে বলে উঠলেন, আরে নাতনীরা কোথায়? আমরা দেখি নেচে চলেছি! এমনি হয়, বয়সের ভারে তাল বেতাল হয়ে যায়।
তাল বেতাল হয়ে আবার শিশুসুলভ ভঙ্গিতে ফিরে আসতে চায়!
হ্যাঁ,
নাতনীদের সঙ্গে দু’দিন পরে দেখা হচ্ছে।
দিল্লি থেকে শিমলা, কুল্লু, মনালী এক সাথে ঘুরব আমরা।
একা বোকা, দোকা প্রায়
বোকারই মত, আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে আর বোকা
ব’নে থাকতে হবে না। মনে
চঞ্চলতা আসবে, আর মনে যদি চঞ্চলতা আসে
শরীর তার সদ্ব্যবহার না করে পারবে না। আমি
হাসিবো, খেলিবো, নাচিবো,
ঘুরিবো আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে রে...
জবলপুর
থেকে রওনা হব। ট্রেনও এখান থেকে ছাড়ে।
স্টেশনে আধঘন্টা আগে পৌঁছে দেখলাম ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
বিনা বাক্যব্যয়ে ট্রেনে চড়ে বসলাম। কাল
ভোরের দিকে পৌঁছবো দিল্লিতে।
তারিখ
- ১৪/০৫/২০১১ ও ১৫/০৫/২০১১
দিল্লিতে
পৌঁছালাম। সেখানে পিসি পিসেমশাইয়ের বাড়ি
দু’রাত কাটিয়ে রওনা হব শিমলার দিকে।
তারিখ
- ১৬/০৫/২০১১
আমাদের
যাত্রা আবার শুরু হল। শিমলার দিকে রওনা হলাম।
সকাল তখন ছটা হবে। শতাব্দি
ট্রেন ছাড়ল কালকা স্টেশনের উদেশ্যে। পথের
সাড়ে চার ঘন্টা সময় তাড়াবার কথা আর ভাবতে হয়নি, নাতনীদের সঙ্গে গল্প করে, হেসে, মজা করতে করতে কখন দেখলাম সময় অনেক কেটে গেছে। পথে
পড়ল ঐতিহাসিক স্টেশন পানিপথ। পাঞ্জাবের
রাজধানী চন্ডিগড়কে ফেলে আমরা পৌঁছালাম কালকা।
কালকা
থেকে টয়ট্রেন যায় শিমলা পর্যন্ত। দুর্ভাগ্যবশতঃ
সে ট্রেন আমরা
কালকা পৌঁছাবার আগেই ছুটে গিয়ে ছিল।
অগত্যা ইনোভা গাড়ি ভাড়া করে আমরা শিমলার উদেশ্যে রওনা হলাম।
হিমাচল
প্রদেশের বেশির ভাগ রাস্তাগুলি উঁচু নিচু পাহাড় বেয়ে চলে গেছে।
আমরাও চলেছি পাহাড়ের ধার বেয়ে তৈরি করা রাস্তা দিয়ে।
মাঝে মাঝে নিচের দিকে দেখে চলেছি ছোট বড় খাদ।
চারিদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। কোথাও
পাহাড়ের গা বেয়ে রচিত হয়েছে ছোট ছোট গ্রাম। সেই
গ্রামের ঘরগুলি দূর থেকে সাজানো খেলনাঘর বলে মনে হচ্ছে
!
হ্যাঁ,
মে মাসের প্রচন্ড গরম যেটা সারা রাস্তায় অনুভব করে আসছিলাম তা কখন যেন
কম হতে হতে ক্রমশঃ ঠান্ডার অনুভব নিয়ে এসেছিল। পাহাড়ি
রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। স্পিড
ত্রিশ কিলোমিটার থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের ভিতরে। দু-চার মিনিট পর পর রাস্তার মোড় কেটে ঘুরে ঘুরে যেতে হচ্ছে।
ড্রাইভার ওই একই স্পিড নিয়ে টার্ন নিয়ে চলেছে।
টার্ন নেবার সময় আমরা বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের
অসীম গহবর খাদগুলির ভয়াবহতার কথা চেষ্টা করেও মন থেকে দূরে সরাতে পারছিলাম না।
রাস্তার দু’পাশের সারি সারি পাহাড়গুলি হঠাৎ তাদের মাথা উঁচু করে
যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে! ওদের যেন প্রতিযোগিতা
চলছে, কার আগে কে ছুঁয়ে নেবে আকাশ!
জানা
অজানা গাছেদের মেলা চলেছে রাস্তার চারদিকে। পাহাড়ের
গা আঁকড়ে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে
মাঝেই দেখা যেতে লাগল ছোট বড় লতানো অনেক গাছেই ফুটে আছে কত রঙবেরঙের ফুল - ছোট বড় কত না আকৃতির! এক নতুন ধরণের গাছ আমাদের দৃষ্টি
কেড়ে নিল। গাছটা হল পাইন গাছ।
অনেকটা ছাতির মত মাথা উঁচু করে থাকা গাছগুলি সৌন্দর্যময়।
ঝির ঝির পাতাগুলি গোল কদম্ব ফুলকে যেন ঘিরে আছে।
অদ্ভুত ফুলের আকারের পাতাগুলি ছেঁকে আছে সবুজের সমারোহ নিয়ে।

কালকা থেকে শিমলার পথের ধারে পাহাড়ের পিঠে গজিয়ে ওঠা পাইন গাছ
জীবনের
ধর্মই তো এগিয়ে যাওয়া - ছুটে চলা।
পৃথিবী ঘুরে যাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে - আনি মানি জানি না, পরের ছেলে মানি না’র মত আমরা নিশ্চিত বসে কোথাও স্থির
থাকতে পারি না। পৃথিবীর মত কেন্দ্রের টানে
ঘরে ফিরে আসার তাগিদ মনে রেখেই তাড়াহুড়ো করে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি।
তাই দেখার চে না দেখা থেকে যায় বেশি। পাহাড়,
গাছ, ফুল, এই নদী,
ঝর্ণা ওরা পথিক যাযাবরদের শুধু দেখে যায়, চিনতে
পারে না! আমরা অপরিচিতই থেকে যাই এই প্রকৃতি থেকে!
স্থানীয়
বাসিন্দাদের কথা আলাদা। ওরা সব দেখে দেখে চোখ ভোঁতা
করেছে। ওরা পাহাড় থেকে নেমে আসে সমতল
দেখতে। ঠান্ডা থেকে নেমে আসে গরমের
আমেজ নিতে।
শিমলা
যত কাছে আসছিল তত ঠান্ডা অনুভব করছিলাম। এ.সি. গাড়ির এ.সি. বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। ভাবছিলাম
ব্যাগের মধ্যে ঠান্ডা থেকে নিজেদের বাঁচাবার পোশাক কি কি এনেছি!
যত
শিমলা কাছে আসছে আশপাশের দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়ে চলেছে। পাইন
গাছের পরিবর্তে দেখতে পাচ্ছি দেবদারু গাছের ছড়াছড়ি। দেবদারু
গাছ পাইন গাছের মতই ছড়ানো, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো,
আকারে বিশাল। উভয়
গাছের পাতার মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখলাম। দেবদারু
গাছের পাতাগুলি বিছানো ধরণের - অনেকটা আমাদের সচরাচর দেখা কৃষ্ণচূড়া গাছের মত ঝাপড়ানো।
তবে কৃষ্ণচূড়া থেকে অনেক লম্বা, মোটা, শক্ত গাছ এই দেবদারু।
এর আবার ভিন্ন ভিন্ন আকার প্রকার আছে। সচরাচর
এ অঞ্চলের পাহাড় পর্বতে যেগুলো দেখা যায় তারই লেখকের তোলা একটি ফটো দেওয়া হলো।

শিমলার পাহাড়ের ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদার বা দেবদারু গাছ
শিমলা
এসে গেল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বা বলা যায়
পাহাড়ের পিঠ বেয়ে গাছপালার বদলে চোখে পড়তে লাগল বাড়ি-ঘর। পাহাড়ি জায়গায় ভূকম্পের ভয়
বেশি থাকে, যার জন্যে শিমলার মত পাহাড়ি এলাকায় বেশির ভাগ
বাড়িঘর কাঠের তৈরি। অট্টালিকার
সংখ্যা কম। পাকা ভিতের ওপর কাঠের কারুকাজ
করা বাড়ি ঘরই বেশি পরিলক্ষিত হয়। ঘর,
বাড়ির ডিজাইনগুলি বড় চমৎকার, শিল্প-নকশামন্ডিত ঘর-বাড়ি শিমলার বিশেষ আকর্ষণ।

লেখকের তোলা ফটোতে দৃশ্যমান শিমলা শহরের একাংশ
শিমলায়
এই রোদ, এই বৃষ্টি। পড়ন্ত
রোদের লাল আভায় হলুদ ঠিকরে পড়া রোদের আঙিনায় শিমলার সাজ-সজ্জা বড় চমৎকার! শিমলা সমতল থেকে ২১০০ মিটার ওপরে অবস্থিত।
এখানকার মন্ত্রমুগ্ধ সৌন্দর্যের আকর্ষণে এক ইংরেজ অধিকারী লেফটিনেন্ট
রোস গোর্খা যুদ্ধের সময় খুঁজে পেয়েছিলেন এ জায়গা। এ
জায়গার নামকরণ এখানকার ঘন বৃক্ষের বনপ্রান্তের ভিতর স্থাপিত দেবী মা শিমলার নামকরণে
হয়েছিল। ইংরেজ শাসনের সময় থেকে শিমলা
ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী।
শিমলার
আকর্ষণের ভিতরে গ্রীন ভ্যালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনবদ্য। এখানকার
স্থানীয় বাজার মাল রোড, অনেকটা বড় মেলার মত।
মশোবরা, শিমলা টাউন
থেকে বারো কিলোমিটার দূরে। ঘন
জঙ্গল পার করে পৌঁছাতে হয় সেখানে। সে
সঙ্গে এখানকার প্রকৃতির শোভাবর্ধন করেছে এখানকার পাহাড়,
পর্বত, পাইন আর দেবদারুর আকাশচুম্বী অবস্থান।
এখানকার ফুলবাগান আর আপেল বাগিচা মনোমুগ্ধকর।
আপেল বাগানে ঘুরে বেড়াবার আনন্দই আলাদা। আমাদের
মে মাসের যাত্রাতে গাছে লাগা বড় আপেল দেখার সৌভাগ্য মেলেনি। তবে
ছোট ছোট আপেল, সবে মাত্র ফুল থেকে ফল
লাগা আপেল-শিশুদের দেখা মিলেছিল! গাছের
ভিতর থেকে ওরা যেন বৌ’টুকি মার ছিল! সবে
মাত্র লালচে রঙ নিচ্ছিল ওদের দেহ।

আপেল গাছে বউটুকি দিচ্ছে লালচে আপেল শিশু
শিমলার
সবচেয়ে উঁচু পর্বতশিখরের উচ্চতা ২৪৫৫ মিটার, সেখানে অবস্থিত জাখু মন্দির। এ
মন্দিরে ভগবান হনুমান দেবের মূর্তি স্থাপিত আছে। এ
ছাড়া ছোটোখাটো দ্রষ্টব্য স্থান হল - কমলা দেবীর মন্দির,
কুকরী, স্থানীয় আদিবাসীদের বসতি, রাজ্য সংগ্রহালয়, ভারতীয় উচ্চতর অধ্যয়ন সংস্থান,
নলদেহেরা, ফাগ ইত্যাদি।
তারিখ
- ১৮/০৫/২০১১
শিমলাতে
দু’রাত কাটিয়ে বের হলাম কুল্লু, মনালির দিকে। পাহাড়ের
কোল ঘেঁষে চড়াই উতরাই পথ ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি। পথে
পড়ল সম্পূর্ণ পাহাড়ের পেট কেটে বানানো তিন চার কিলোমিটারের লম্বা এক টানেল।
ভয়ঙ্কর গিলে খাওয়া অন্ধকারকে মুছে ফেলার জন্যে নির্ধারিত দূরত্বে
দূরত্বে রাখা ছিল লাইটের ব্যবস্থা। ভিতরে
অক্সিজেনের ঘাটতি ছিল বটে, তবে শ্বাস-প্রশ্বাসের বিশেষ ব্যতিক্রম ধরা পড়েনি। কুল্লু
যাবার পথে এই টানেলটার কথা মনে রাখার মত ছিল বটে।
একটা
জিনিস লক্ষ্য করছিলাম, ব্যাস নদী আমাদের সঙ্গে
সঙ্গে ছুটে চলেছে। এই নদীর এপাশ ওপাশ হয়ে আমরাও
ছুটে চলেছি কুল্লু মনালির দিকে। কোথাও
গভীর, কোথাও সামান্য জল নিয়ে ছোট বড় পাথর-নুড়িতে আঘাত খেয়ে খেয়ে লক্ষ বাধা পেরিয়ে খরস্রোতা ব্যাস চলেছে এগিয়ে।
কুল্লুতে
পৌঁছালাম। সঙ্গে সঙ্গে এসেছে সেই ব্যাস
নদী। তাতে ব্যবস্থা রয়েছে রাফটিংয়ের।
বড় রোমাঞ্চকর ব্যাপার। পাহাড়ি
নদী, উত্তাল ঢেউ পাথর ভেঙে বেরিয়ে তিন-চার কিলোমিটার দূরত্ব বোটে পার করতে হবে! ঠাকুরের নাম
জপ করতে করতে চড়ে বসলাম তাতে। বোট
কখনও ঢেউ নিয়ে তিন-চার ফুট ওপরে লাফিয়ে উঠছে,
আবার কখনও তিন-চার ফুট নিচে ঢালানে গিয়ে পড়ছে।
এই ওঠা-নামার সঙ্গে
সঙ্গে বারবার আমরাও ভয়ে চীৎকার করে উঠছিলাম। চারদিক
থেকে জল উছলে এসে আমাদের একেবারে নাকানি চোবানি অবস্থা! আমরা সবাই ভিজে গেলাম। কখনও
ঢেউ বোটের ওপর দিয়ে, এমনকি আমাদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে - আমি,
আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে আর এগার বছরের নাতনী বোটে
বসা। রোমাঞ্চ আমাদের মনে,
শরীরে - ভয় উল্লাস আনন্দ মিলিয়ে আমাদের রাফটিং
শেষ হল।
কুল্লুর
বাকি জায়গাগুলি আমরা যাইনি, কারণ, আমাদের প্রধান যাত্রাস্থল ছিল মনালির রোটাং পাস পর্বত চূড়া।
যেখানে বরফ আর বরফ, বর্তমানে সমতলে যখন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরম চলছে, ঠিক সে সময় বরফের দেশে যাত্রা কতই না মজার ব্যাপার! সন্ধে
হতে বেশি দেরি নেই, এমনি সময় দেখা যেতে লাগল দূরের বরফমোড়া পাহাড়গুলিকে! আবছা আলোয় বরফ ঢাকা পাহাড়ের মাথাগুলি ক্রমশঃ জেগে উঠতে লাগল।
সূর্য ডোবা সামান্য আলোতেও পাহাড় চূড়া শ্বেত রঙে চকচক করে উঠছে।
মেঘ, গাছপালা, অসংখ্য উঁকি ঝুঁকি মারা ছোটো বড়ো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দেখা দিচ্ছে রজতাভ পাহাড়,
পর্বতের চূড়া, যা দেখতে আমাদের এত দূর থেকে এখানে
আসা, তারই এক ঝলক আমাদের মনকে আনন্দ দিয়ে গেল।

তখন মনালি ছুঁই ছুঁই, সূর্য ডোবা সামান্য আলোয় দূরের
রজতাভ পাহাড়
যাই হোক, রাত আটটার
মধ্যেই আমরা আমাদের
মনালির কটেজে পৌঁছে
গেলাম। কটেজ
সিমেন্টেড স্ট্রাকচারে তৈরি, ভিতরের সাজসজ্জা সম্পূর্ণ
কাঠের। হ্যাঁ,
যেটা বলা হয়নি, চলতে চলতে
কুল্লুর আগেই আমাদের
শরীরে চড়ে গেল
গরম জামাকাপড়। যত আমরা
এগোচ্ছিলাম, ততই
ঠান্ডা আমাদের জড়িয়ে
ধরছিল।
তারিখ
- ১৯/০৫/২০১১
আমাদের
মনালির হোয়াইট পার্ল কটেজের বন্ধ জানালার কাচ দিয়ে দেখি পাহাড় চূড়া ঢাকা শুভ্র বরফের
স্তুপ। নিচে তাকিয়ে দেখি পাহাড় বেয়ে
আসা উত্তাল তরঙ্গময়ী নদী। শুনতে পাচ্ছিলাম তার প্রায়
সমুদ্রের মত গর্জন, ছোট ছোট ঝর্ণার পাহাড়
বাওয়া পতনের দৃশ্য বড় মনোহর! দূর থেকে ঝর্ণার গতিপথকে মনে হয়
যেন হীরক গলা জল, সাপের শরীরের মত এঁকেবেঁকে নেমে এসে সশব্দে
নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে! পাহাড়ের গায়ে জন্মানো পাইন, রেইন, দেবদার গাছেরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

দূরের ঝর্ণারা আর দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ে পাইন, রেইন, দেবদার গাছেরা
হিড়িম্বার
মন্দির দর্শনে গেলাম। হিড়িম্বা দেবী ছিলেন রাক্ষসী।
পঞ্চপান্ডবের এক পান্ডব ভীমের স্ত্রী ছিলেন তিনি।
ভীম নিষ্ঠুর রাক্ষস হিড়িম্বকে বধ করে তার বোন হিড়িম্বাকে বিবাহ
করেন। সেই হিড়িম্বার নামেই তৈরি এ
মন্দির।
মনালির
বেলা বাড়তে থাকে। ঢাকা পাহাড়ের বরফ গলতে থাকে।
বরফ জলের মিশ্রণ পাহাড়ের গা বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে নীচের দিকে।
এ যে আর এক দৃশ্য! বরফের স্তর চিরে বেরিয়ে আসে ছোট ছোট দ্বীপের মত সবুজ আচ্ছাদন ঘেরা পাহাড়ের
অংশ। সে এক নতুন সৌন্দর্য দর্শন
- বড় নয়নাভিরাম!

রোদে গলা বরফ পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য
তারিখ
- ২০/০৫/২০১১
মনালির
প্রধান আকর্ষণ বরফ ঢাকা পাহাড় চূড়া – রোহটং পাস পর্বত চূড়া - যেটা সারা বছর প্রায় বরফে ঢাকা
থাকে। তাকে দেখাই তো প্রধান আকর্ষণ
মনালির! প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা পার করে পৌঁছাতে
হবে রোহটং পাস চূড়ায়। প্রায়
সবটা রাস্তাই পাহাড় চড়ে ওপরে উঠে যাওয়া। সমতল
থেকে এই উচ্চতা প্রায় ৩৯৮০ মিটার। পাহাড়
কেটে রাস্তা ক্রমশঃ উঠে গেছে ওপরে, আরও ওপরে। একদিকে পাহাড়,
অন্য দিকে গভীর থেকে গভীরতম খাদ। যাত্রীদের
আনন্দের সঙ্গে মনের এক কোণে লেগে থাকে আতঙ্ক! ড্রাইভারের সামান্য অসতর্কতার পরিণাম যে কী ভয়ঙ্কর হতে পারে সে চিন্তা সামান্য
হলেও সবার মনকে নাড়া দিয়ে যায়। রোহটাং
বা রোটাং যাবার পথে বরফ পাহাড়ের দৃশ্য আমাদের মন ভরিয়ে দিচ্ছিল।
তেমনি এক বরফ ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে নিলাম।

লেখকের ক্যামেরায় বন্দি করে রাখা বরফ ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য, মনালি
রোটাং
পর্বতের বরফচূড়া তখন তিন কিলোমিটার দূরে।
এত গাড়ির ভিড়ে আমরা জ্যামে পড়ে গেলাম। এখান
থেকে ঘোড়ায় চড়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছবার ব্যবস্থা আছে। আমরা
ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওনা হলাম। এবড়োখেবড়ো একমানুষ চলার সরু পথ ধরে ঘোড়া
চলেছে ঊর্ধ্বমুখী। তাল থেকে একটু বেতাল হলেই আমাদের
অসময়ে স্বর্গবাস অবধারিত! কারণ পথের আধ হাত দূরত্বেই
বিশাল খাদ ! মনে হচ্ছিল এর চেয়ে হেঁটে যাওয়াই কী শ্রেয় ছিল না!
এভাবে টালমাটাল ঘোড়ার খুরের ভরে একসময় পৌঁছে গেলাম মনালির সবচেয়ে বড়
আকর্ষণ রোটাং পাস পর্বতচূড়ায়।

রোটাং পাস পর্বতের চূড়ায় দাঁড়ানো লেখক, মনালি
বরফের
ওপর চড়া, সেখানে স্লেজ গাড়ি চড়া। বরফ
পাহাড়ে চড়া, আবার নিচে নেমে আসা।
বরফের গুঁড়ো মুঠি করে গায়ে ছোঁড়াছুঁড়ি খেলা বড় মজার খেলা। এখানে
বয়সের বন্ধন ছুটে যায়, সবাই বাচ্চাদের মত হৈহল্লা হুড়োহুড়ি
খেলাধুলায় মেতে ওঠে! শরীর নাড়তে না পারা লোকগুলোও উঠে যায় বরফ
পাহাড়ের অনেকটা, কখনও সে পড়ে যায়, কখনও
সে গড়ায়, খেলাখেলি কম নেই তাদেরও!

রোহটং পাস বরফচূড়ার আনন্দ নিতে নিতে লেখকের স্ত্রী, মেয়ে
ও বড় নাতনী
আশপাশের
দৃশ্যগুলিও কম সুন্দর ছিল না।

রোটাং পাশের আশপাশের দৃশ্য কম সুন্দর ছিল না।
লেখকের তোলা ফটো
হিমাচল
প্রদেশের আদিম পর্বতবাসীদের পোশাকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। স্থানীয়
লোকের কাছ থেকে ভাড়ায় নিয়ে আমরা সাজলাম আদিম পর্বতবাসী।

পাহাড়ীদের বেশে লেখকের বড় জামাই, মেয়ে ও নাতনীরা
মনালী
থেকে প্রায় ষোলো কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সোলাং ভ্যালি। প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এ জায়গা। রোটাং
পাসের পর দর্শনীয় বলতে একেই বলতে হয়। রোপওয়ে
দিয়ে পাহাড় চূড়ায় আরোহণ করে নিচের উপত্যকার ছোট বড় গ্রামগুলিকে বড় সুন্দর দেখায়।

সোলাং ভ্যালির পাহাড়চূড়া থেকে দৃশ্যমান ভ্যালির ছোটবড় গ্রামের ঘরগুলি

সোলাং ভ্যালির রোপওয়ে স্টেশন ও প্যারাগ্লাইডিং সেন্টার, মনালি
ইয়াকে
চড়ে বাচ্চাদের ঘুরে বেড়ানোও একটা আনন্দদায়ক ব্যাপার।

ইয়াক, স্থানীয় পশু, বাচ্চারা এর
পিঠে চড়ে আনন্দ নেয়
মনালিতে
যেমন আপেলের বাগান আছে তেমনি রয়েছে চেরিফলের বাগান। লাল,
কালো, দু’রকমের চেরিফলই এখানে পাওয়া যায়।
হিমাচলের জঙ্গলেও এ গাছের অভাব নেই। নিচের
ছবিতে চেরিফলের গাছ, তাতে চেরি ফল ধরে আছে।

এ
ছাড়া মনালির বাকি দর্শনীয় স্থান হল - ক্লাব হাউজ, জৈন মন্দির, রহল্লা
ফল, কোঠী জগৎ সুখ, নেহেরু কুন্ড,
অর্জুন গুফা, তিব্বতি মেনেসট্রি ইত্যাদি।
তারিখ
- ২৩/০৫/২০১১
দিল্লি
ফিরে আসলাম। সেখানে এক রাত থেকে রওনা হলাম
ঘরের দিকে।
তারিখ
- ২৪/০৫/২০১১
জবলপুরে,
মানে ঘরে ফিরে এলাম। মনে
হচ্ছিল এত দিন পরে বুঝি যাত্রার পরিশ্রমটা অনুভব করছি।
______
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment