
ভূতুড়ে
পিয়ানো
পুষ্পেন
মন্ডল
সদ্য
কলেজে উঠে আমার একবার ঝোঁক চেপেছিল, পিয়ানো শেখার। শিয়ালদাতে আমাদের হোস্টেলের কিছু
দূরে একটা পুরনো বাড়িতে এক বয়স্ক মহিলা পিয়ানো শেখাতেন। বিকেলের দিকে সপ্তাহে
একদিন করে ক্লাস হত। যদিও পড়াশোনার চাপে আমার সেই বাদ্যযন্ত্র শিক্ষা বেশি দূর
এগোয়নি। তা এতদিন পরে আমার জীবনে আবার একটা পিয়ানো ফিরে এসেছে। ভূতুড়ে পিয়ানো। সেই
গল্পই আজ তোমাদের আমি বলব।
ক’দিন
আগের কথা, পিকুদা ওরফে পল্লবকান্তি গুহ, আমাদের পাড়ার তরুণ অধ্যাপক কাম দাদা হঠাৎ
বিশুদার চায়ের দোকানে আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, “শুনলাম তুই নাকি পিয়ানো বাজাতে
পারিস?”
আমতা
আমতা করে জানালাম, “তেমন কিছু নয়, মোটামুটি। শিখেছিলাম
অনেকদিন আগে।”
“ভালো,
তা সামনের খ্রিস্টমাসের ছুটিতে কী করছিস?”
“কোনও
ঠিক নেই এখনও পর্যন্ত। কেন?”
“একটা
ঘুরতে যাবার প্ল্যান আছে। ক’দিনের
জন্য শীতের পোশাক নিতে হবে।”
ভেবেছিলাম
কোনও পাহাড়চূড়ায় ট্রেকিং করতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। কিন্তু যাবার দিন কলকাতা
এয়ারপোর্টে এসে জানতে পারলাম, গন্তব্য গুয়াহাটি।
প্রশ্ন
করলাম, “কী ব্যাপার পিকুদা, হঠাৎ গুয়াহাটি?”
বোর্ডিং
পাশ বের করে সে উত্তর দিল, “ওখান থেকে যাব শিলং।”
“শিলং!”
কথাটা
শুনে মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল। মেঘেদের রাজ্য মেঘালয়ের মাথায় শৈলশহর শিলংয়ের নাম
ছোটোবেলায় লীলা মজুমদারের বইয়ে পড়েছি।
তবে
শিলংয়ে আসার পেছনে পিকুদার যে গূঢ় অভিসন্ধি ছিল সেটা বিমানে আসতে আসতে জানলাম। পিকুদা
বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষের বাংলাদেশের ছাতকে জমিদারি ছিল। ইংরেজ
আমলে শিলংয়ে একটা বাড়ি কিনেছিলেন দাদুর এক ভাই হরনারায়ণ গুহ। এরপর
দেশভাগের সময়ে আমরা কলকাতার পাশে মফস্বলে এসে বসবাস শুরু করি। শিলংয়ের
বাড়িটা ভারতের মধ্যে পড়ায় সেটা আর বিক্রি করা হয়নি।”
আমি
বললাম, “এর আগে তো কোনওদিন শুনিনি তোমাদের এই বাড়ির কথা।”
“আসলে
হরনারায়ণের একমাত্র ছেলে এক মেমকে বিয়ে করে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেজন্য
তাঁর সাথে পরিবারের অন্য কেউ কোনও যোগাযোগ রাখেনি। এতদিন
আমার সেই জেঠুই আগলে রেখেছিলেন সেই বাড়িটাকে। নিঃসন্তান
জেঠুর মৃত্যুর পরে সেই সম্পত্তি আমাদের ভাগে এসে পড়েছে।
উকিলের চিঠি পেয়েছি ক’দিন আগে। জেঠু নাকি মৃত্যুর আগে উইল করে গিয়েছিলেন। তাই এই সপ্তাহ
খানেকের ছুটি পেতে ভাবলাম ঘুরে আসি।”
আমি
সব শুনে প্রশ্ন করলাম, “আমাকে সঙ্গে নেওয়ার কী দরকার ছিল? বৌদিকে তো নিয়ে যেতে
পারতে।”
পিকুদা
বিমানসেবিকার কাছ থেকে জল চেয়ে নির্লিপ্ত গলায় জানাল, “তোর বৌদিকে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই
ওঠে না, কারণ তার বড্ড ভূতে ভয়।”
জল
খেতে গিয়ে আমার বিষম লেগে গেল, “মা-মানে?”
“শুনেছি
শিলংয়ের বাংলোতে নাকি ভূত আছে। আমাদের আত্মীয়দের মধ্যেই হয়ত কেউ রটিয়েছে কথাটা।”
জলের
পাত্রটা শেষ করে প্রশ্ন করলাম, “কী রটিয়েছে সেটা খুলে বলবে তো?”
হঠাৎ
একটা এয়ার-পকেটে পড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল বিমানটা।
“মাঝরাতে
নাকি বাংলো থেকে পিয়ানোর আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু পিয়ানোবাদককে দেখা যায় না। এছাড়া
আরও কিছু ভূতুড়ে ঘটনার কথা শোনা গেছে। ফালতু যত
গুজব।” একটু থেমে গোঁফের নিচে মিচকে হেসে আবার বলল, “এখন তোর যদি এই কথা শুনে ফিরে
যেতে মন চায়, তাহলে পরের ফ্লাইটে চলে যেতে পারিস।”
ফিরে
যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি হলাম
যাকে বলে ওস্তাদ সিদ্দিক আলির চেলা। পাড়ার আখড়ায় বক্সিং থেকে কুস্তি, জুডো, ক্যারাটে
কিছুই বাদ রাখিনি শিখতে। একসময়ে বালির বস্তায় ঘুসি মেরে মেরে আঙুলে কড়া পড়ে
গিয়েছিল। সামান্য ভূতের ভয়ে ফিরে যাব? যদিও শেষপর্যন্ত আমার যা অবস্থা হয়েছিল সে
কথায় পরে আসছি।
‘লোকপ্রিয়
গোপীনাথ বরদলই’ এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে যখন আরাম করে বসলাম
সূর্য তখন পশ্চিমদিকে ঢলতে শুরু করেছে। ড্রাইভার
জানাল, শিলং পৌঁছাতে তিন-চারঘণ্টা লাগবে। দেখলাম
রাস্তাঘাট বেশ চওড়া আর ঝাঁ-চকচকে। কিছুটা পর থেকেই সবুজ পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে শুরু
করল গাড়ি।
পথে
দু’বার দাঁড়াতে হল। একবার একটা পাঞ্জাবী ধাবায় আর একবার
‘উমিয়াম লেক’-এর সামনে। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে উঠতে ডানদিকে চোখে পড়ল বিশাল বড়ো নীল
জলের লেক। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে ক্রমশ। সঙ্গে তেমনি বেজায় ঠাণ্ডা
নামছে। শিলংয়ে যখন ঢুকলাম তখন চারদিকে ঝলমল করছে
খ্রিস্টমাসের রঙিন আলো।
বাংলোটা
খুঁজে পেতে সময় লাগল। শহরের ঘিঞ্জি এলাকা থেকে বেশ কিছুটা দক্ষিণে ‘ক্যামেল ব্যাক
রোড’ ধরে গিয়ে বাঁদিকে পড়ল একটা সরু পাহাড়ি রাস্তা। পাইন আর বার্চের জঙ্গলের মধ্যে
দিয়ে সেই উঁচুনিচু পথে গাড়ি করে কুয়াশায় মোড়া অন্ধকার ঠেলে প্রায় দু’শো ফুট এগোতে
পাহাড়ের গায়ে ইউরোপিয়ান ধাঁচের কাঠের চিমনিওলা বাংলো।
আলো-আঁধারিতে এমন মোহময় ছবি আগে দেখিনি কখনও। শুনেছিলাম
মানুষের মনের সাথে মস্তিষ্কের নিবিড় যোগাযোগ আছে। গাড়ি থেকে নিচে নামতেই শরীরটা
যেন শিরশির করে উঠল। কেন তা বলতে পারব না। আকাশে তখন টুকি দিচ্ছে সন্ধ্যাতারা। ঝিঁঝিঁর
একটানা শব্দ। সামনের লনে একটা সাদা দোলনা। চারদিকে পাতাবাহারি আর রঙিন ফুলগাছের
সমারোহ। কিছুটা দূরে একটা সাদা স্করপিও দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়ির
হর্ন শুনে যখন কেউ এগিয়ে এল না, অবাক গলায় পিকুদা স্বগতোক্তি করল, “আমাদের
আসার কথা তো আগে থেকে জানানো ছিল কেয়ারটেকারকে। সে কি চিঠি পায়নি?”
এগিয়ে
গিয়ে বড়ো কাঠের দরজায় আওয়াজ করলাম কয়েকবার। কোনও সাড়াশব্দ নেই। অথচ আলো জ্বলছে ভেতরে।
লক্ষ পড়ল বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আশ্চর্য!
“কাকে
চাই?”
অকস্মাৎ
ভারী গলায় প্রশ্নটা পেছন থেকে কানে আসতে আমরা ঘুরে দেখলাম একজন মধ্যবয়স্ক লম্বা
মানুষ দাঁড়িয়ে। গায়ে নীল রঙের ফুলস্লীভ সোয়েটার আর মাথায় কালো
গোল টুপি। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। আমরা তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভ্রূ দু’টি
উপরে তুলে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখে ইংরেজিতে
বললেন, “তোমরা নিশ্চয়ই মিঃ গুহর ভাইপো। আমি তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কর্নেল
থাপার সাথে কথা বলতে গিয়ে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। এস, ভেতরে এস।”
“কিন্তু,
কেয়ারটেকার...”
ভদ্রলোক
মেন গেট খুলে বললেন, “বংশীর বাড়িতে একজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আজ সকালে চাবিটা
আমার কাছে দিয়ে চলে গেছে।”
পিকুদা
একটু ইতস্তত করে জানতে চাইল, “আপনাকে কোথাও যেন দেখেছি মনে হচ্ছে!”
“আমাকে
চেনার কোনও কারণ আছে বলে মনে হয় না, যদি না শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বদ অভ্যাস থাকে।”
“মনে
পড়েছে, ঠুমরীর একটা ক্যাসেটে আপনার ছবি আছে আমাদের বাড়িতে।”
“তাই?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। আমার নাম সদানন্দ পালিত। তোমার জেঠুর
বহুদিনের বন্ধু। যদিও বয়েসে ওনার থেকে অনেক ছোটো। চলো,
বাকি কথা ভেতরে গিয়ে হবে।”
দেখলাম
বাংলোটা বেশ বড়ো। ঘরের সংখ্যা পাঁচ। মাঝখান দিয়ে চওড়া
করিডোর।
ভদ্রলোক
আমদের একটা ঘর খুলে দিয়ে বললেন, “তোমরা একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি ডাইনিংরুমে
অপেক্ষা করছি। আমি আবার রাতেই গুয়াহাটি ফিরব।”
ঘরটা
বেশ জাম্বো সাইজের এবং আধুনিক সবরকম সুবিধা সমেত। হাতমুখ গরম জলে ধুয়ে পোশাক পালটে
গিয়ে দেখি পালিতবাবু একাই সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন।
পিকুদা
বলল, “বাবা! আপনি তো মেলাই আয়োজন করেছেন দেখছি!”
“না,
তেমন কিছু নয়। হোটেল থেকে কিনে এনে মাইক্রোওভেনে গরম করেছি শুধু। বংশী নেই, তোমরা
এতদূর থেকে আসবে। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা তো কিছু একটা করতে হবে।”
আমি
প্রশ্ন করলাম, “আজকে কি ঠাণ্ডাটা বেশি পড়েছে?”
“ডিসেম্বরের
শেষে এটাই স্বাভাবিক টেম্পারেচার। ভোরের দিকে
দেখবে জানালার কাঁচে, গাছের পাতায়, ঘাসের উপরে কীরকম সাদা কুচি কুচি বরফ ছেয়ে থাকে।”
পিকুদা
খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল, “আর কেউ থাকে না এখানে?”
“কেয়ারটেকার
ছাড়া একজন কাজের লোক আছে। সে সকালে
এসে সব কাজ সেরে চলে যায়। দু’দিন ধরে সেও কোনও কারণে আসছে না।”
“জেঠুর
মৃত্যুটা কীভাবে হয়েছিল জানেন আপনি?”
“মাইকেল
শম্ভুচরণ গুহ চেন স্মোকার ছিলেন। ফলে অনেকদিন থেকেই ভুগছিলেন হার্টের অসুখে। ওনার
যেদিন হার্ট-অ্যাটাক হয়, সেদিনও আমি এখানেই ছিলাম। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ
দেননি। বয়েস হয়েছিল সত্তরের গোড়ায়।”
পিকুদা
বলল, “ওনার সাথে আমাদের কোনও কালেই তেমন গাঢ় সম্পর্ক ছিল না। তাই আমরা বিশেষ কিছুই
জানি না। ভাবতে অবাক লাগে এত বছর ধরে আমি জানতামই না যে আমাদের এত সুন্দর একটা শৈলাবাস
আছে।”
পালিতবাবু
মাথা নেড়ে বললেন, “সুন্দর কি না বলতে পারব না। তবে এ বাড়ির বদনামও আছে। ভয়ে কেউ
ধারে কাছে ঘেঁষে না।”
পিকুদা
আমার দিকে আড়চোখে একঝলক তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “আমিও কিছুটা শুনেছি। কী ব্যাপার একটু
খুলে বলবেন?”
কিছুক্ষণ
চুপ করে থেকে বললেন, “এখানে এসে যখন পড়েছ, সব জানতে পারবে। আর
একটা কথা বলে রাখি, যদি এই বাংলো বিক্রি করার কথা ভেবে থাক, তাহলে কিন্তু বিপদে
পড়তে হবে। তোমাদের পূর্বপুরুষও এক ইংরেজের কাছ থেকে এই
বাড়িটা কিনেছিলেন, সেটা জান নিশ্চয়ই। বাড়িটা বিক্রির পরে তাদের বংশের সবাই একে একে
অপঘাতে মারা গেছে।”
পিকুদা
হেসে উত্তর দিল, “বিক্রির কথা ভাবিনি এখনও। আমার ইচ্ছা এখানে একটা ইউরোপিয়ান ধাঁচে
রিসর্ট তৈরি করার।”
পালিতবাবু
বললেন, “উত্তম প্রস্তাব। তবে...”
ভদ্রলোক
আরও কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন চেপে গেলেন মনে হল।
কিছুটা
পরে পিকুদা আবার প্রশ্ন করল, “আপনি কি এখানে প্রায়ই আসেন?”
“হ্যাঁ,
তবে ওনার মৃত্যুর পর থেকে আমার আসা অনেক কমে গেছে। আমি থাকি গুয়াহাটিতে। এখানে
পারিবারিক কাঠের ব্যবসা আছে। গান বাজনার
পাশাপাশি এসবও দেখাশোনার দায়িত্ব আমার উপর। গুহসাহেবের
সাথে অনেকদিনের পরিচয়। উনি আমার গানের খুব ভক্ত ছিলেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত প্রকৃত
বোঝে এমন লোক তো খুব বেশি পাওয়া যায় না।”
“তা,
ক’টা দিন আমাদের সাথে থেকে যান এখানে। আমরাও তো একেবারে নতুন।”
“থাকতে
পারলে ভালোই হত। কিন্তু সেটা হবার নয়। খাওয়া শেষ করেই আমাকে বেরোতে হবে। কাল ভোরের
ফ্লাইটে চলে যাব মুম্বাই। রেকর্ডিং আছে।”
“বেশ।”
আমি
জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার কি শুধুই ক্লাসিক্যাল?”
“হ্যাঁ,
তার মধ্যে ঠুমরী, দাদরা, গজল এগুলোও পড়ে। বিদেশেও
গেছি বহুবার, অনুষ্ঠান করতে। নিজের একটা স্কুল আছে গুয়াহাটিতে।”
“আচ্ছা,
এ বাড়ির বদনামের কথা কী বলছিলেন? একটু খোলসা করে বলুন না।”
একটু
ইতস্তত করে গম্ভীর গলায় বললেন, “ঘটনাটা একটা পিয়ানোকে নিয়ে। সে গল্প তোমাদের
বিশ্বাস হবে না। বাদ দাও ওসব কথা।”
“তবুও
বলুন, বিশ্বাস হোক না হোক শুনে রাখা দরকার।”
আমরা
দু’জনে অনুরোধ করতে শেষে বললেন, “আচ্ছা বলছি, তবে এ কথা বাইরের লোককে বলা চলবে না।
আর যদিও বল, নাম-ধাম পালটে বলবে। আসলে সঙ্গীত-জগতের
লোকেরা আমাকে তো একডাকে চেনে।” এই কথা বলে প্রথমেই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
“পিয়ানো প্রথম কে তৈরি করেছিলেন বলতে পারবে?”
আমরা
দু’জনেই মাথা নাড়লাম।
“বার্টোলমি
ক্রিস্টোফার। উনি ইটালিতে একটা বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। প্রথম
পিয়ানো তৈরি করেছিলেন আনুমানিক সতেরশো তিরিশ সাল নাগাদ। সেই পিয়ানোর সাথে অবশ্য
বর্তমান যুগের পিয়ানোর খুব একটা মিল নেই। আঠারোশো শতকের মাঝামাঝি ইউরোপে
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভোলুশানের সময়ে ‘জেন হেনরি পেপে’ আধুনিক পিয়ানোর ডিজাইন তৈরি
করেন। এরপরে আসে ‘গ্র্যান্ড পিয়ানো’,
‘ভার্টিকাল পিয়ানো’ প্রভৃতি। তারপর বিখ্যাত কম্পোজার বিটোফেন ও মোৎজার্ট তাঁদের
অনুষ্ঠানে পিয়ানোর ব্যাবহার শুরু করেন। তখন থেকেই সারা পৃথিবীতে বাদ্যযন্ত্র
হিসাবে পিয়ানোর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।”
একটু
থেমে আবার বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ যে শম্ভুচরণ ধর্ম পালটে এক খ্রিস্টান মেয়েকে
বিয়ে করেছিলেন। তাঁর নাম ছিল রোজ। রোজের দাদু ইংরেজ আমলে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী
ছিলেন। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য মারা গিয়েছিলেন প্রচুর ধারদেনা রেখে।
রোজের বাবাও মারা যান কম বয়েসে। তখন ওনাদের অবস্থা খুব খারাপ। শম্ভুচরণের বাবা
হরনারায়ণ গুহ তখন এই বাড়িটা রোজের মা মরিয়মের কাছ থেকে খুব কম টাকায় কিনেছিলেন।
কিন্তু ছেলে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করবে স্বপ্নেও ভাবেননি। মানসিক শোকে তাঁর মৃত্যু
হয়। মরিয়ম ছিলেন ইংল্যান্ডের এক অভিজাত
বাড়ির মেয়ে। সম্ভবত তিনি বিয়ের সময়ে পারিবারিক ‘গ্র্যান্ড’ পিয়ানোটা যৌতুক
পেয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৮৪৩ সালে ফ্রান্সে তৈরি - থ্রি ‘প্যাডেল’ আর ১২০টা ‘কি’
সম্বলিত এক অসাধারণ বাদ্যযন্ত্র। ঘন বাদামী
রঙের হার্ডউডের উপর চকচকে পালিশ করা। তেমনি
অপূর্ব সুন্দর তার মিষ্টি আওয়াজ।”
এই
পর্যন্ত বলে পালিতবাবু চোখ বন্ধ করলেন। মনে মনে সম্ভবত তিনি ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
“তারপর?”
“আমাদেরও
আদিবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে। এখানে ঘুরতে এসে দেখেছিলাম পিয়ানোটা। রোজ আর জুলি খুব
যত্ন করত। জুলিও দারুণ ভালো বাজাতে পারত।
এখনও চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, কানে আওয়াজটা ভেসে আসে।”
পিকুদা
অবাক গলায় প্রশ্ন করল, “জুলি কে?”
“শম্ভুদার
মেয়ে।”
“জেঠুর
মেয়ে ছিল! জানি না তো!”
“ছবি
আছে বসার ঘরে। বছর বারো বয়েস হয়েছিল তার। একদিন
একটা চিঠি পেলাম শম্ভুদার, রোজ আর জুলি দু’জনেই আত্মহত্যা করেছে।”
“আত্মহত্যা!
কেন?”
“এ
প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া একটু মুশকিল। ঘটনাটা প্রায় কুড়ি বছর আগের।
আমি শম্ভুদার মুখে কিছুটা শুনেছি। একদিন
সন্ধ্যার সময়ে রোজ জুলিকে পিয়ানো শেখাচ্ছিল। হঠাৎ অদ্ভুত একটা সুর বেজে উঠল
পিয়ানোয়। শম্ভুদা তখন রিডিংরুমে ব্যস্ত ছিল নিজের কাজে। কিছুক্ষণ মাত্র শোনা
গিয়েছিল সেই সুরটা। তারপরে সব নিস্তব্ধ। অনেকক্ষণ পরে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে শম্ভুদা
ওদের নাম ধরে ডাকে। কিন্তু কোনও উত্তর আসেনি।
তারপর উঠে গিয়ে দেখে ঘরে কেউ নেই। শুধু পিয়ানোটা পড়ে
আছে। তারপর এদিক ওদিক খুঁজেও তাদের কোথাও পাওয়া যায়নি। পরেরদিন পাহাড়ের খাদে পাঁচশো
ফুট নিচে পাওয়া যায় মৃতদেহ।”
“আশ্চর্য!
আত্মহত্যার পেছনে তো কোনও কারণ থাকবে। পুলিশ তদন্ত করেনি?”
“হ্যাঁ।
শম্ভুদার উপরেই সব সন্দেহ গিয়ে পড়ল। ওর জেল হয় চৌদ্দ বছর। তারপর ফিরে এসেও শান্তি
পায়নি সারাজীবনে।”
আমি
প্রশ্ন করলাম, “পিয়ানোটা এখন কোথায়?”
“কোণের
তালাবন্ধ ঘরে পড়ে আছে বহুকাল। কিন্তু বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে পিয়ানোর আওয়াজ এখনও
শোনা যায় মাঝে মাঝে। জানি তোমাদের কথাটা বিশ্বাস হবে না। তবু এটা সত্যি। আমার
ধারণা, অপঘাতে মৃত আত্মারা এখনও এখানেই আছে। অনেক সময়ে এরকম হয়, যাঁরা মারা গেছেন
তাদের সেই ধারণাটাই নেই যে তাঁরা ইহলোকের বাসিন্দা নন।”
একটু
থেমে পালিতবাবু আবার বললেন, “জেল থেকে ফিরে এসে শম্ভুদা বিভিন্নরকম নেশা করতে শুরু
করে। আমি বারণ করায় বলল, তার নাকি রাতে ঘুম হয় না। কারণ, প্রায়ই মাঝরাতে বাংলোর
মধ্যে পিয়ানোর আওয়াজও শোনা যায়। আমি প্রথমে কথাটা হেসে উড়িয়ে দিই। কিন্তু তিনি
আমাকে এখানে রাত কাটাতে বলেন। সেদিন ছিল
গুড ফ্রাইডে। এই ঘড়িতে রাত বারোটার ঘণ্টা শেষ হল।
আমরা দু’জন বসেছিলাম ড্রয়িংরুমে। হঠাৎ বেজে উঠল পিয়ানোটা।
আওয়াজটা আসছিল পাশের বড়ো ঘর থেকে। এখনও ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
আমি ঘরে ঢুকে দেখি পিয়ানোটা বসানো আছে টিমটিমে আলোর নিচে। আগেও
ওখানেই থাকত। পিয়ানোটা বাজছে। কিন্তু যিনি বাজাচ্ছেন তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। সুরটা
খুব চেনা। জুলির প্রিয় সুর। এক পা এক
পা করে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম পিয়ানোর রিডগুলো অদৃশ্য কোনও আঙুলের চাপে ওঠানামা করছে।”
“তারপর?”
“এ
কথা বাইরের লোককে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই আমরাও পাঁচকান করিনি। কিন্তু সবাই
ভেবে নিয়েছে শম্ভুদাই নিজের বউ মেয়ের হত্যাকারী আর তাদেরই আত্মারা এসে পিয়ানো
বাজায় মাঝরাতে। সেজন্য এ বাড়ির ধারে কাছে কেউ আসে না।”
আমাদের
খাওয়া ততক্ষণে শেষ। হাতমুখ ধুয়ে পালিতবাবু বললেন, “আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখ।
দরকার হলে ফোন করবে। আমি এবার বের হব। আর একটা কথা, ড্রয়িংরুমের দেরাজের মধ্যে সব
চাবি রয়েছে।”
সাদা
গাড়িটা করে চলে গেলেন। তাঁর কথাগুলো বিশ্বাস করা কঠিন।
জানি না এ বাড়িতে কী রহস্য লুকিয়ে আছে! আপাতত এই অচেনা ভূতুড়ে বাড়িতে রাত কাটবে কী
করে সেটাই ভাবছি।
পিকুদা
বলল, “কালকে সকালে পুরো বাড়িটা ভালো করে দেখা যাবে। এখন চল শুয়ে পড়ি।”
**************
নিজেদের
ঘরে এসে রুম হিটার চালিয়ে দিলাম। পালিতবাবুর কথাগুলো শুনে অন্ধকার জানালা বা খাটের
নিচেও তাকাতে ভয় লাগছে। পিকুদা ছোটো সাইড ল্যাম্পটা জ্বেলে শিলংয়ের পটভূমিতে লেখা
রবার্ট বুকির আত্মজীবনীটা আবার খুলে বসল। বিমানেও দেখেছি এই বইটায় চোখ গুঁজে বসে
থাকতে।
রাতে
ঘুম হল ছেঁড়া ছেঁড়া। একে তো নতুন জায়গা, আবার একটা
অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। মাঝরাতে পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে আমি একা। কীভাবে পৌঁছলাম জানি
না। পথ হারিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটছি। হঠাৎ একটা সুরেলা শব্দ কানে এল। পিয়ানোর
মিষ্টি আওয়াজ। মনে হচ্ছে শব্দটা কখনও দূর থেকে আসছে, কখনও কাছ থেকে। ঘন গাছপালা
ঠেলে আমি এগোচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ পরে দূর থেকে চোখে পড়ল
সাদা আবছা কুয়াশায় মোড়া অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে একটি বাচ্চা মেয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে।
মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। সেদিকে এগিয়ে গেলেই কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। আবার
হারিয়ে যাচ্ছি জঙ্গলের মধ্যে।
মনের
মধ্যে অস্বস্তিকর চিন্তাভাবনা এসে ভিড় করলে ঘুম এমনিতেই পাতলা হয়। তার উপর আবার
নতুন জায়গা। মাঝরাতে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যেতে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকলাম। একটা
অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। অন্ধকারে চোখটা সয়ে যেতে খেয়াল হল পাশের বিছানায় পিকুদা
নেই। বুকটা ধড়াস করে উঠল। বালিশের নিচে থেকে পেনসিল টর্চটা বের করে জ্বাললাম। ঘরের
মধ্যেও কোথাও নেই। বাথরুমেও যায়নি। ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে বুকের ভেতরটা। এরকম
অজানা জায়গায় মাঝরাতে উঠে কোথায় গেল সে?
বেশ
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শেষে শালটা জড়িয়ে বের হলাম বাইরে। করিডোর ফাঁকা। টিমটিম
করে কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। নিজের পায়ের শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। এক পা
এক পা করে এগোলাম। চেঁচিয়ে যে ডাকব পিকুদার নাম ধরে সে
ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছি। বাড়ির পেছনদিকে একটা দরজা আছে। সেখান দিয়ে ফুরফুর করে
ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। কী ব্যাপার, দরজাটা খোলা কেন? কেউ কি বাইরে বেরিয়েছে? দরজার
হাতলটা ধরে সবে টানতে যাব, আচমকা পেছন থেকে একটা আওয়াজ কানে এল। কেউ
যেন দৌড়ে চলে গেল করিডোর দিয়ে। একটা আবছা আলোর নড়াচড়া। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। একটা
অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হচ্ছে চারপাশে অন্ধকারের মধ্যে থেকে কারা
যেন আমাকে লক্ষ রাখছে। ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে তারা।
হঠাৎ
কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ। চমকে উঠে ছিটকে গেলাম দু’হাত।
“কী
রে? তুই আবার এত রাতে কী করছিস এখানে?”
পিকুদার
গলা শুনে বুকের ধড়ফড়ানি একটু কমল। “কো-কোথায়
গিয়েছিলে তুমি? বিছানায় দেখতে না পেয়ে আমি আবার খুঁজতে বের হলাম।”
“ঘরে
চল, বলছি।” বলে পেছনের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে ঘরে এসে ঢুকল। খাটের
উপর বসে বলল, “যা বলব সেটা শুনে ভয় পাবি না।” ঘড়ির দিকে
একবার তাকিয়ে বলল, “তখন রাত প্রায় পৌনে তিনটে হবে। হঠাৎ আমার ঘুমটা আচমকা ভেঙে
গেল। বাইরে কাঠের মেঝের উপর দিয়ে একটা হেঁটে যাওয়ার শব্দ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে
বিছানা থেকে উঠে টর্চটা নিয়ে বের হলাম বাইরে। কাউকেই দেখতে পেলাম না। ভাবলাম,
তাহলে কি আমার মনের ভুল! এগিয়ে গিয়ে দেখি, পেছনদিকের দরজাটা খোলা। শুধু হালকা করে
ভেজানো রয়েছে। ছিটকিনি বা তালা কিছুই দেওয়া নেই। অথচ রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি
দরজাগুলো চেক করেছিলাম। বাইরে বেরিয়ে লক্ষ পড়ল বেশ কিছুটা দূরে অন্ধকার একটা গাছের
নীচ দিয়ে কে যেন চলে গেল। একটা ডাক দিলাম, ‘কে ওখানে?’ কোন সাড়া এল না। এগিয়ে গিয়ে
দেখলাম, ইউক্যালিপটাসের গাছটা পেরিয়ে পূর্বদিকে খাদের ধার দিয়ে একটা সরু পায়ে চলা
পথ জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেছে। মনে হল একটা আবছা ছায়া চলেছে ঐদিকে। আমিও
বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে পাথরের কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে এগোলাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ
কিছুটা চড়াই উৎরাই হেঁটে শেষে পৌঁছলাম একটা ফাঁকা জায়গায়। দেখি পাথুরে জমিতে
চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি সাইজের পাথর। তার
উপর ক্রসচিহ্ন। খেয়াল হল, সেগুলো আসলে সিমেট্রির বেদি।”
“মানে
গোরস্থান!”
পিকুদা
মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, সেখানে অনেক খুঁজেও কাউকে পেলাম না। ফেরার সময়ে খাদের পাশ
দিয়ে যখন আসছি হঠাৎ কেউ একজন ধাক্কা মারল পেছন থেকে। খাদের মধ্যে পড়েই যেতাম,
ভাগ্য ভালো ছিল বলে একটা গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে বেঁচে গেছি।”
“কে
ধাক্কা মারল তোমাকে?”
“তাকে
যদি দেখতে পেতাম তাহলে তো ঝামেলা মিটেই যেত।” কিছুক্ষণ গুম খেয়ে থেকে বলল, “এখন
শুয়ে পড়, কাল সকালে উঠে খোঁজখবর করা যাবে।”
ঘুম
কি আর অত সহজে আসে? মন শুধু বলছে, কিছু তো একটা আছে বাড়িটাতে। যেন
আমাদের জানান দিচ্ছে, যে আমরা এখানে অনাহূত।
*************
পরের
দিন ঘুম ভাঙল দিনের আলোয় পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে। চেয়ে দেখি পাশের বিছানায়
পিকুদা নেই। চাদরটা জড়িয়ে বাইরে বের হতে চোখে পড়ল সামনের সবুজ ঘাসে মোড়া লনের উপরে
দোলনায় বসে ক্যাঁচকোঁচ করে দোল খাচ্ছে। আমার দিকে
আড়চোখে দেখে বলল, “তুই এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাস জানা ছিল না।”
“আসলে
নতুন জায়গা তো! তার উপরে কাল রাতের সব বিদঘুটে কাণ্ডকারখানা। মনে হয় ভোরের ঘুমটাই
গাঢ় ছিল।” আড়মোড়া ভেঙে চারপাশে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করলাম, “তা আজকে কী করণীয়?”
“আপাতত
রেডি হয়ে নে। ডাইনিংরুমে হিটারে কফি করে রেখেছি। এছাড়া
এখানে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা কিছু নেই। বেরিয়ে আগে পেটে কিছু দিতে হবে। তারপর যাব
এডভোকেটের কাছে। ওনার কাছেই মাইকেল শম্ভুচরণ গুহর উইল রাখা আছে।”
এরপর
সারাদিন কাটল কিছু কাজের মধ্যে আর কিছু ঘুরে বেড়িয়ে। এডভোকেট মিঃ সাহানির বাড়ি
গিয়ে জানা গেল গতকাল একটা জরুরি কাজে তিনি গুয়াহাটিতে গেছেন। ফিরতে রাত হবে।
অগত্যা আমাদের পরেরদিন আবার আসতে হবে।
পাহাড়ি
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এবার কোথায়?”
“বাংলোর
কাছেই একটা চার্চ আছে, দেখেছিস?”
“হ্যাঁ,
একটা পুরনো চার্চ দেখলাম আসার পথে। কেন?”
“কালকে
রাতে দেখা সিমেট্রিটা ঐ চার্চের লাগোয়া। চল একবার
ঘুরে আসি ওখানে। কয়েকটা ইনফরমেশন দরকার।”
প্রাচীন
চার্চটি জঙ্গলের মধ্যে। হেঁটে গেলে তবেই চোখে পড়বে। শ্যাওলা ধরা পাথরের সিঁড়ি উঠে
গেছে কিছুটা। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। কেউ কোথাও নেই। একেবারে
শান্ত, নিরিবিলি, নিস্তব্ধ। বড়দিনের প্রচুর পুড়ে গলে যাওয়া মোমবাতি চোখে পড়ল।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়েছে কিছুটা অংশ। কয়েকটা পাখির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই
কানে আসছে না। বাইরে বেরিয়ে ডানদিক দিয়ে চার্চের পেছনে একটা রাস্তা চলে গেছে
পাহাড়ের ঢালে। সম্ভবত সেদিকেই গোরস্থান। গাছপালায় মোড়া।
পিকুদাকে
অনুসরণ করে এগোতে দেখি পাহাড়ের ঢালে অনেকটা জায়গা জুড়ে সমাধিগুলো আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
নতুন পুরনো বেশ কিছু সিমেন্টের বেদি পেরিয়ে শেষে খুঁজে পাওয়া গেল মাইকেল শম্ভুচরণ
গুহর নাম। নিচে লেখা রয়েছে, ‘রেস্ট ইন পিস’, জন্ম – ১৮ই
অগাস্ট, ১৯৩৯ আর মৃত্যু – ৫ই অক্টোবর, ২০১৫। সূর্যের তেজ এমনিতেই কম। তার
উপর গাছের ছায়ায় ঠাণ্ডাটা এখানে আরও বেশি।
পিকুদা
বলল, “আমাদের বাংলোর পেছন দিয়ে একটা সরু রাস্তা এসেছে এই গোরস্থানে।”
আমি
একটু মজা করেই জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা! কাল রাতে যে ছায়ামূর্তি দেখেছিলে, তিনি কি
জীবিত না মৃত?”
পিকুদার
উত্তর আসার আগেই একটা ভারি গলায় প্রশ্ন এল পেছন থেকে, “কী চাই এখানে?”
চমকে
উঠে ঘুরে দেখি এক বয়স্ক পাদ্রী। পিকুদা বলল, “মাইকেল শম্ভুচরণ গুহ আমার আত্মীয়।
ওনার মৃত্যুর সময়ে আমরা আসতে পারিনি। তাই এখানে এসেছিলাম শ্রদ্ধা জানাতে।”
কথাটা
শুনে আমাদের আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ করলেন পাদ্রী মহাশয়। তারপর বললেন, “তোমরা কি
কলকাতা থেকে আসছ?”
“হ্যাঁ,
আচ্ছা, ওনার স্ত্রী আর মেয়ে তো আগেই মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের সমাধিগুলো কোথায়?”
পাদ্রী
হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর গলায় বললেন, “সে ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমি এখানে ছিলাম
না তখন। শুনেছি শম্ভুচরণ মানসিক অশান্তির জেরে নিজেই বউ আর মেয়েকে হত্যা করে লাশ
গায়েব করে দিয়েছিল।”
“কিন্তু
সদানন্দ পালিত তো অন্য কথা বললেন।”
হঠাৎ
তিনি চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন, “কে?”
“সদানন্দ
পালিত। সঙ্গীতশিল্পী।”
এবার
চোখ বড়ো বড়ো করে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করলেন, “তোমরা এখন কোথায় আছ?”
“আমরা
তো ঐ বাংলোতেই উঠেছি। কালকে রাতে এসেছি।”
“ঐ
বাড়ি নিরাপদ নয়, ওখানে অপদেবতার বাস। যত তাড়াতাড়ি পার ওখান থেকে চলে যাও।” গম্ভীর
গলায় কথাটা বলে তিনি হনহন করে চলে গেলেন চার্চের দিকে।
পিকুদা
হঠাৎ চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আর একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। কর্নেল থাপার
বাড়িটা কোথায়?”
প্রশ্নটা
শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। আমাদের দিকে ঘুরে উত্তর দিলেন, “তোমরা ওনাকে চিনলে কী
করে? তিনিও তো বছর পাঁচেক আগে খাদে পড়ে মারা গেছেন।”
তারপর পিছন ফিরে চলে গেলেন।

পিকুদা
হেসে চশমাটা নাকের উপর চেপে বসিয়ে বলল, “এই যুগে দাঁড়িয়েও এসব গল্প শুনতে হয়,
বুঝলে রমাকান্ত!”
এখানে
‘রমাকান্তটা’ কে সেটা অবশ্য আমার জানা নেই।
যাই
হোক, এরপর আবার মেন রোডে এসে দু’তিনজন স্থানীয় লোককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল কর্নেল
থাপার বাড়িটা আমাদের বাংলো থেকে বেশ কিছুটা পশ্চিমে, পাহাড়ের গায়ে। তবে সেখানে কেউ
থাকে না। কথাটা শুনে পিকুদা যেন আরও উৎসাহ পেল। বলল, “চল তো, একবার ঘুরে আসা যাক।
কালকে সন্ধ্যাবেলায় মিঃ পালিত বললেন, কর্নেল থাপার সাথে গল্প করতে গিয়ে দেরি হয়ে
গেল। এদিকে তিনি নাকি পাঁচবছর আগেই মারা গেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার!”
জঙ্গলের
মধ্যে দিয়ে প্রায় আধঘণ্টা হেঁটে দেখা পাওয়া গেল সেই পোড়ো বাড়িটাকে। চারদিকে
আগাছা আর কাঁটা ঝোপঝাড় ভর্তি। বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বললাম, “একেবারে যে লোকজন
আসে না তা নয়। দেখ, দরজার হাতলে একফোঁটাও ধুলো নেই। চাবি খুলে নিয়মিত কেউ ঢোকে মনে
হচ্ছে।”
“ঠিকই
বলেছিস। চ, পেছনদিকটা ঘুরে আসি।”
সেদিকে
গিয়ে লক্ষ পড়ল একটা জানালার আধখানা কাঁচ ভাঙা। পাশে একটা গাছ থেকে শুকনো ডাল ভেঙে
এনে সজোরে মারতে বাকিটাও ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। এরপর পিকুদা
সেটা দিয়ে গলে ঢুকে গেল ভেতরে। আমাকে বলল, “বাইরে থেকে পাহারা দে। কেউ এদিকে আসলে শিস
দিবি।”
অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকলাম চুপচাপ। প্রায় আধঘণ্টা পরে তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে শুধু বলল,
“ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
হাতে
দেখলাম একটা পুরনো মোটা বই আর একটা পোকায় খাওয়া খাতা।
“কীসের
বই এটা?” তার পিছনে বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলাম।
“ডার্ক
ফিজিক্স।”
“সেটা
আবার কী? জীবনে কোনওদিন শুনিনি।”
“অ্যালকেমির
নাম শুনেছিস?”
“মানে
অপরসায়ন? বইয়ে পড়েছি। ইউরোপে রাসায়নিক দ্রব্যের সাথে ভূত, প্রেত, জড়িবুটি মিশিয়ে
অপরসায়নের চর্চা হত। কম দামী ধাতু থেকে সোনা তৈরির চেষ্টা ছিল অ্যালকেমির প্রধান
কাজ। কিন্তু সে তো অনেক আগে। তখন আধুনিক বিজ্ঞান এত উন্নতি করেনি।”
“ঠিকই
বলেছিস। রসায়নের মতো পদার্থবিদ্যা নিয়েও এই ধরনের অনেক গবেষণা হয়েছে। আঠারোশো শতকের
মাঝামাঝি ইউরোপে যখন শিল্পবিপ্লব ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল, তখন কিছু বিজ্ঞানী এই ‘ডার্ক-ফিজিক্স’
নিয়ে কাজ করেন।”
“তা
সে বই এখানে এল কী করে?”
“জানি
না।” হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলল, “আমি বাংলোয় ফিরছি। তুই এক কাজ কর, হোটেল থেকে সারাদিনের
মতো খাবার কিনে দিয়ে আসবি। তারপর তোর
ছুটি। এখানে যা কিছু দেখার আছে, একবার ঘুরে নে।”
সেই
মতোই ব্যবস্থা করলাম। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে একাই ঘুরে দেখলাম শিলংয়ের দর্শনীয় স্থানগুলো।
‘এলিফ্যান্ট ফলস’, ‘ওয়ার্ড'স লেক’, ‘শিলং পিক’, ‘এয়ারফোর্স বেস’।
কিন্তু আমার মনের মধ্যে থেকে উচাটন ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না। ভাবছি সারাদিন বাইরে
ঘুরে বেড়ালেও রাতে তো ওখানেই ফিরতে হবে! পিকুদা উদাসীনভাবে সবকিছু হেসে উড়িয়ে
দিলেও আমি কিন্তু পাদ্রীর কথাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আর কালকে রাতের সেই
অদ্ভুত অনুভূতিটা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যার
মুখে আবার যখন ফিরলাম বাংলোয়, দেখি তখনও পিকুদা চশমা এঁটে সেই বইতে মুখ গুঁজে বসে
আছে। এগিয়ে গেলাম টেবিলের দিকে। সকালে ভালো করে দেখা হয়নি। এখন খুঁটিয়ে লক্ষ
করলাম, পুরো বইটা হাতে লেখা। তবে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোর উপর টানা হাতের ইংরেজি
অক্ষরগুলো মুক্তোর মতো ঝকঝক করছে। দু’একটা পাতা ওলটাতে কিছু সুরের নোটেশন চোখে
পড়ল।
প্রশ্ন
করলাম, “তোমার বইটা পড়তে আর কতক্ষণ লাগবে? আমি একবার দেখতাম।”
উত্তর
এল, “আজকে মনে হয় হবে না। কাল পাবি।”
শেষে
বুকশেলফ থেকে একটা ইংরেজি উপন্যাসের বই বের করে খুলে বসলাম। ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে ন’টায়
ঠেকল, পিকুদা মুখ তুলে বলল, “চল, রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া যাক।”
কালকের
থেকে আজকের ঠাণ্ডাটা আরও বেশি পড়েছে। আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক
পরে বসার ঘরে ফায়ারপ্লেসের আগুনটা জ্বেলে সবে ওম নিতে শুরু করেছি, বাইরে একটা
নিশাচর পাখি কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উড়ে গেল। পিকুদাকে লক্ষ করছি কোনও কথা বলছে
না। খাওয়ার টেবিলেও চুপচাপ ছিল। এরকম গুম খেয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইতে শুধু বলল,
“ঝড়ের পূর্বাভাস।”
“মানে?”
“মন
বলছে আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে।”
“কী
ঘটবে?”
“সেটা
একটু পরেই টের পাবি।”
“আচ্ছা,
তুমি কি ঐ কোণের ঘরটা খুলেছিলে?”
“হ্যাঁ,
দুপুরে তুই খাবার দিয়ে চলে যাবার পরেই খুলেছিলাম। মোটা ধুলোর স্তর জমা হয়েছে
পিয়ানোটার উপরে।”
আবার
একটা কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। মনে হল, একটা
ধাতব ঘর্ষণের আওয়াজ। বাড়ির বাইরে থেকে আসছে। পিকুদা উঠে গিয়ে বৈঠকখানার জানালার
পর্দাটা আস্তে আস্তে সরিয়ে দিল। দেখলাম, বাইরের লনে যে সাদা দোলনাটি আছে সেটি
দুলছে। কোন ঝড় নেই, বাতাস নেই, তবু আপনা-আপনি দুলছে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক্যাঁচ ...
সারা
শরীরের রক্ত যেন দৌড়োতে শুরু করল। আমি একটা ঢোঁক গিলে ধরা গলায় প্রশ্ন করলাম, “কী
ব্যাপার?”
পিকুদা
কোনও উত্তর দিল না। ইলেকট্রিকের আলোটা কেমন যেন দপদপ করছে। কিছুক্ষণ পর আবার সব নিস্তব্ধ। এবার
কানে এল একটা অন্যরকম শব্দ। ঝুম.. ঝুম.. ঝুম.. যেন নূপুর পায়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে
করিডোর দিয়ে। ঠিক শুনছি তো? নাকি আমারই মনের ভুল! আর তখনই ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজা
শুরু হল ব্রিটিশ আমলের পেন্ডুলাম লাগানো ঘড়িটাতে। ঘণ্টার আওয়াজ শেষ হওয়া মাত্র
কানে এল পিয়ানোর শব্দ। পাশের ঘর থেকেই ভেসে আসছে। পিয়ানোর সুরের সাথে ভিতরে ঢুকছে
হাড়-কাঁপুনি ঠাণ্ডা। পিকুদার দেখলাম অসীম সাহস। দরজাটা খুলে পর্দা সরিয়ে বাইরে
বেরিয়ে গেল একা। আমি তো তখন উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। তবু চুম্বকের
টানের মতো তার পেছন পেছন বের হলাম।
করিডোর
ফাঁকা, শুনশান করছে। শব্দটা আসছে কোণের ঘর থেকে। পিকুদা দৌড়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমের
দেরাজ থেকে চাবির থোকাটা নিয়ে এসে খুলল তালা। ঠেলতে ক্যাঁচ করে খুলে গেল। জোর
হল পিয়ানোর আওয়াজটা। ভিতরে গাঢ় অন্ধকার। দেয়াল হাতড়ে সুইচে চাপ দিতে একটা মৃদু আলো
জ্বলে উঠল ঘরের কোণে। ঠিক আলোর নিচেই রয়েছে পিয়ানোটা। সেটা
নিজে থেকেই বাজছে। আশ্চর্য!
পিকুদা
এগিয়ে গেল। টর্চের আলোয় আমিও গুটিগুটি পায়ে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, বহুদিনের
পরিষ্কার না করা ঝুল আর ধুলোয় মোড়া রিডগুলো নিজে থেকেই ওঠানামা করছে। যেন কোনও
অদৃশ্য মানুষ বাজাচ্ছে ওটাকে। কি বোর্ডে কেউ আঙুল দিলে তো ধুলোর স্তর মুছে যাবে!
কিন্তু অবাক ব্যাপার, তা হচ্ছে না। সুরটার মধ্যে যেন একটা সম্মোহন রয়েছে। আস্তে
আস্তে মাথাটা ভোম হয়ে যাচ্ছে। চিন্তাশক্তিগুলো কাজ করছে না। ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের
সামনেটা। এর মধ্যে আবার বাইরে থেকে একটা মেয়েলি অট্টহাসি
আওয়াজ কানে এল, হি.. হি.. হি..
এক
ঝটকায় পিকুদা আমাকে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে এসে তীরবেগে দৌড়ে পিছনের দরজা খুলে
বেরিয়ে গেল। আমিও দৌড়ালাম তার পিছনে। কিন্তু
বাইরে বেরোতেই অন্ধকারের মধ্যে সজোরে একটা
বাড়ি খেলাম মাথায়। তারপর ব্ল্যাক আউট।
*************
পিকুদার
ডাকে চোখ খুলে দেখি ঘরে বিছানার উপর শুয়ে আছি।
জানালার কাঁচ দিয়ে সকালের আলো দেখা যাচ্ছে। ও চোখের
ইশারায় প্রশ্ন করল, সব ঠিক আছে? আমি খাটের
উপর উঠে বসে মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম ব্যান্ডেজ বাঁধা। “কালকে রাতে কী ঘটেছিল?”
“তেমন কিছু না, মাথাটা সামান্য একটু ফেটেছে, আর একটা আলু গজিয়েছে।”
“কে
মারল আমাকে?”
“কেয়ারটেকার
বংশী। টার্গেট যদিও আমি ছিলাম। তবে, আগেই যদি তোকে
খোলসা করে সব বলে দিতাম তাহলে হয়তো এটা হত না।”
“এখন
কি পুরো ঘটনাটা খুলে বলবে?”
“বলছি,
আর একজনের আসার কথা আছে।”
কথা
শেষ হতেই ঘরের দরজায় আওয়াজ হল ঠক ঠক করে। “কাম ইন।”
ভিতরে
ঢুকলেন একজন কালো সুট টাই পরা মধ্যবয়স্ক লোক।
“আইয়ে
মিঃ সাহানি। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি হলেন এডভোকেট মিঃ সাহানি। আমাকে চিঠি
লিখে এখানে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ব্যায়ঠিয়ে স্যার।”
তাঁকে
একটা চেয়ারে বসতে বলে পিকুদা শুরু করল, “আপনিও শুনুন মিঃ সাহানি, কেসে কাজে লাগবে।
গল্পটা শুরু হয়েছিল আঠারোশো শতকের মাঝামাঝি ফ্রান্সের ‘সেন্ট-কুইন্টিন’ শহরে।
পিয়ানো তৈরি নিয়ে তখন গোটা ইউরোপ জুড়ে মাতামাতি চলছে। জেকব গ্র্যান্ডি নামে এক
বিজ্ঞানী ‘ডার্ক ফিজিক্স’-এর চর্চা করতেন। তিনি অদ্ভুত একটা পিয়ানো বানালেন। এটা
ছিল এক ধরনের অস্ত্র। এর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সুর বাজালে
মানুষের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। অন্য একধরনের
বিশেষ সুর বাজালে মানুষ হয়ে যেতে পারে বদ্ধ উন্মাদ। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটা
সত্যি। তবে এই সুরের নোটেশনগুলো তিনি কাউকে দেননি। লিখে রেখেছিলেন একটা বইয়েতে। আর
একটা গুণ আছে এই পিয়ানোটার। এটাকে এলার্মের মত ব্যবহার করা যায়। পূর্বনির্ধারিত
বছরের বিশেষ কিছু দিনে এটা নিজে থেকেই বাজতে শুরু করবে। তবে এই পদ্ধতি চালু করার
জন্য কিছু কলকাঠি নাড়তে হবে। সেটাও সবার দ্বারা সম্ভব নয়। যিনি এই পিয়ানোটা বানিয়েছিলেন,
তিনি নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনেন। ১৮৬৫-তে পিয়ানো বাজাতে গিয়ে তাঁর হার্ট-অ্যাটাকে
মৃত্যু হয়। তখন কেউ বুঝতেই পারেনি যে ওটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এরকম ঘটনা অন্য
বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। বিপদজনক কিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময়ে
অসাবধানতাবশত নিজেরাই অনেক সময়ে মারা যান। যাই হোক, পিয়ানোটা এর পরে কোনওভাবে হাত
ফিরি হয়ে ইংল্যান্ডের থমসন পরিবারে আসে। তার অনেক বছর পর সেটা বিবাহের যৌতুক
হিসাবে এসে পৌঁছায় এখানে।”
একটু
থেমে আমাদের চোখের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে আবার বলল, “কুড়ি বছর আগে সেই রাতে একটা
দুর্ঘটনা ঘটে। এটা সম্পূর্ণ একটা কাকতালীয় ব্যাপার। রোজ জুলিকে প্রতি সন্ধ্যায়
পিয়ানো শেখাত। সেদিন আকস্মিকভাবে এমন একটা সুর
বাজিয়ে ছিল যার ফলে জুলির মস্তিষ্কে বিকার ঘটে। সে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে পিছনের খাদে
ঝাঁপ দেয়। আর তাকে বাঁচাতে গিয়ে রোজও মারা যায়। কিন্তু শম্ভুচরণ এসব কিছুই বুঝতে
পারেনি। তাঁর সন্দেহ যায় কর্নেল থাপার দিকে। কারণ তিনিও প্রায়ই সন্ধ্যার সময়ে এ
বাড়িতে আসতেন পিয়ানো শুনতে। তারপর চৌদ্দ বছর জেল খেটে বেরিয়ে শম্ভুচরণ সুযোগ
খুঁজছিলেন। একদিন এসেও গেল সেই সুযোগ। গল্প করতে করতে খাদের দিকে নিয়ে গিয়ে ঠেলে
ফেলে দিলেন কর্নেলকে। কিন্তু সেই ঘটনার সাক্ষী থেকে গেলেন মিঃ পালিত। এই পালিত
হচ্ছেন মহা বুদ্ধিমান আর ধুরন্ধর লোক। বাদ্যযন্ত্রের বিষয়ে তিনি অনেক খোঁজখবর
রাখেন। বিদেশেও গেছেন বহুবার। এই ‘ডার্ক-ফিজিক্স’-এর
হাতে লেখা বইটা সংগ্রহ করে এনেছিলেন ইউরোপ থেকে। সম্ভবত কোনও নিলামে কিনেছিলেন
এটা। তারপর এখানে এসে এই পিয়ানোটা দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তারপর ঘন ঘন আসতে
শুরু করেন এখানে। শম্ভুচরণ নেশা করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে
থাকতেন আর এই বইটার সাহায্যে তিনি পিয়ানোটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। এমনভাবে সেট
করেছিলেন এটাকে যাতে বিশেষ বিশেষ দিনে পিয়ানোটা নিজে থেকেই বেজে ওঠত। সবাই ভাবত
রোজ, জুলি বা কর্নেলের আত্মারা ফিরে এসেছে।”
“তারপর?”
আমার মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে গেল।
“আমার
বিশ্বাস, শম্ভুচরণ গুহর মৃত্যুটাও স্বাভাবিক হার্ট-অ্যাটাক ছিল না। পিয়ানোয় সেই সুর
বাজানো হয়েছিল যাতে তাঁর হার্ট-অ্যাটাক হয়। এই পিয়ানোসমেত পুরো বেওয়ারিশ সম্পত্তির
অধিকার নেওয়াই ছিল মিঃ পালিতের মুখ্য উদ্দেশ্য। এডভোকেট সাহানির কাছে যে উইল করা
ছিল এবং কলকাতার ঠিকানা খুঁজে তিনি আমাদের চিঠি পাঠাতে পারেন, সেটা উনি স্বপ্নেও
ভাবেননি। আর আমি এখানে আসাতে তাঁর সব পরিকল্পনা গুলিয়ে যায়। শুধু আমাদের ভয়
দেখানোই নয়, দু’বার আমার উপর পরিকল্পিত হামলাও হয়। তিনি চাইছিলেন যাতে কোনওরকমে
আমাকে তাড়ানো যায় এখান থেকে।”
আমি
বললাম, “যাক! আসলে তাহলে কোনও ভূত নেই!”
ভুরুটা
নাচিয়ে পিকুদা বলল, “সে কথাটা ঠিক জোর গলায় বলতে পারছি না। আগেরদিন রাতে আমাকে পেছন
থেকে ধাক্কা দিয়ে যখন খাদে ফেলে দেওয়া হল, তখন হাত বাড়িয়েছিলাম কিছু একটা ধরে
বাঁচার জন্য। আর শক্ত লতানে একটা ডাল পেয়েও গেলাম। আশ্চর্যের বিষয় কাল দুপুরে আমি
ঐ জায়গায় গিয়ে আবার ভালো করে লক্ষ করেছি, কিন্তু সেখানে না ছিল ওরকম কোনও লতানে
ডাল, আর না কোন গাছ! তাহলে কে বাঁচাল আমাকে?”
কথাটা
শুনে আমাদের মুখ হাঁ হয়ে গেল।
মিঃ
সাহানি কিছুক্ষণ পরে প্রশ্ন করলেন, “পিয়ানোর আবিষ্কারক নিজে ঐ সুর বাজিয়ে মারা
গিয়েছিলেন। তাহলে পালিত কি করে শুধু শম্ভুচরণ কে মারতে সক্ষম হলেন?”
“সম্ভবত
মিঃ পালিত শম্ভুচরণকে যখন সুরটা শুনিয়েছিলেন, তখন ওনার নিজের কানে তুলো বা হেডফোন
গোঁজা ছিল। ফলে শব্দের প্রতিক্রিয়া তাঁর নিজের মস্তিষ্কে আঘাত করেনি।”
আমি
মাথা নেড়ে বললাম, “আর একটা কথা, ঐ বইটা কর্নেল থাপার বাড়িতে গেল কী করে?”
“কেয়ারটেকার
বংশীকে যখন চিঠি দিয়ে জানাই যে আমি এখানে এসে ক’দিন থাকব, সেই চিঠি পালিতবাবু
দেখেছিলেন। তখন তিনিই প্ল্যান করে ঐ বইসমেত বংশীকে কর্নেল
থাপার পোড়ো বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। আমি
কালকে সেখানে গিয়ে সেই আস্তানা দেখে এসেছি। এই ‘ডার্ক ফিজিক্স’-এর বইয়ের সাথে
সেখানে কর্নেলের লেখা একটা ডায়রিও খুঁজে পেলাম। সেটা পড়ে আমার কাছে পুরো ছবিটা
পরিষ্কার হয়। বাকিটা কাল রাতে বংশী আমার হাতে ধরা পড়ার পর নিজের মুখে সব স্বীকার
করেছে। সে-ই আমাকে খাদে ঠেলে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আর
বাকি যা যা ভূতুড়ে কাণ্ড এ বাড়িতে ঘটেছে, সবই ওর কারসাজি। মোটা টাকার লোভ সামলাতে
পারেনি। আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময়ে পালিতবাবু অসাবধানতাবশত কর্নেল থাপার নাম
নিয়েই মস্ত বড়ো ভুল করেছিলেন।”
এরপর
এডভোকেট সাহানি বললেন, “আপনার লিখিত অভিযোগ পেয়ে আজ ভোররাতে মিঃ পালিতকে শিলংয়ের
‘ব্লু ইন’ হোটেল থেকে খুন এবং ষড়যন্ত্রের চার্জে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।”
পিকুদা
হাতদু’টো পেছনে দিয়ে পায়চারি করতে করতে বলল, “বেশ। তাহলে এখন এই ভূতুড়ে পিয়ানোটা
নিয়ে কী করা যায় তাই ভাবছি।”
বললাম,
“আমি একবার চেষ্টা করে দেখব? বাজাতে পারি কি না?”
কথাটা
শুনে দুজনেই এত জোরে ‘না...’ বলে চেঁচিয়ে উঠল যে জানালার পাশে মাধবীলতার গাছ থেকে
দু’টো ফিঙে প্রাণভয়ে উড়ে পালাল।

********************
ছবি - লেখক
বেশ সুন্দর... একটানা পড়ে ফেললাম। লেখকের কাছে একটা ছোট প্রশ্ন... যে বাজনায় জুলি-র মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে যায় সেই একি বাজনায় রোজ-এর কেন মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়না... খুব মাথা না ঘামালেও চলে যদিও। খুব ভাল লাগলো গল্পের থিম-টা।
ReplyDeleteBhalo laglo....besh bhoy pelam golpota pore...subheccha
ReplyDelete