
সিনেমাঃ ছায়াময়
রিভিউঃ মহাশ্বেতা
রায়
নগর-শহর-গঞ্জ
ছাড়িয়ে সে এক পুরোদস্তুর গ্রাম শিমূলগড় - সেখানে এখনও যায়নি বিজলি বাতি, সেখানে এদিক
সেদিক বাঁশবন, ঝোপঝাড়, জঙ্গল, ভাঙা
রাজপ্রাসাদ; সেখানে
চন্ডীমন্ডপে সন্ধ্যেবেলা গপ্পের আসর বসায় গ্রামের যত বুড়ো। আর সেই গ্রামে রয়েছে যত
সব অদ্ভূত চরিত্রের মানুষ - ভন্ড সন্ন্যাসী কালী কাপালিক, যে কিনা
কালো গাইয়ের দুধ খেতে বেজায় ভালবাসে। আছেন গ্রামের সবথেকে বুড়ো দাদু
গৌরগোবিন্দবাবু, যাঁর
বয়স একশোর কাছাকাছি,
কিন্তু তাঁর একটাও চুল পাকেনি, একটাও দাঁত পড়েনি, আর তিনি আরও
বহু বছর বাঁচতে চান,
কারণ তাঁর এখনও একগাদা মামলার রায় বেরোনো বাকি। আছেন এক গণক ঠাকুর রামবাবু, যিনি প্রায়
সবসময়েই চুপ করে থাকেন,
কেবলমাত্র মাঝেমধ্যে তাঁর মুখ দিয়ে এক একটা কথা বেরোয়, আর সেই
কথাগুলো একদম ফলে যায়। আছে ভয়ানক কিপটে মহাজন গগন সাঁপুই, যে কিনা খুব
খারাপ একটা লোক; তার
আছে অনেক ষন্ডা-গুন্ডা পাইক -লেঠেল, যাদের দিয়ে সে গরিব মানুষদের ভয়
দেখিয়ে ঠকিয়ে জমি-সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। গগনের খাস পাইকের নাম লক্ষণ, তার গায়ে
খুব জোর, কিন্তু
মাথায় গোবর পোরা। আছে কালু আর পীতাম্বর -
টাকা নিয়ে মানুষকে পেটানো থেকে খুন, সবই এরা করে থাকে। দুজনেই দেখতে
বেজায় ষন্ডা, হাতির
মত খায়, কিন্তু
বোকার হদ্দ। আর আছে অলঙ্কার নামের এক ছোট্ট ছেলে। অলঙ্কারের পরিবার বড়ই গরিব। তার
বাবা পেশায় স্বর্ণকার,
কিন্তু গ্রামে গঞ্জে আর সোনার গয়না মানুষ কতই বা বানাবে, ফলে
অলঙ্কারদের বড়ই কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে।
তা একদিন
রাতে কিনা সেই ভয়ানক কিপটে গগন সাঁপুইয়ের বাড়িতে চোর ধরা পড়ল। শুধু ধরা পড়ল না, তার কাছ
থেকে পাওয়া বড়সড় একটা থলিতে নাকি ভর্তি গগন সাঁপুইয়ের বাড়ি থেকে চুরি করা জিনিষ।
গগনের পাইক-লেঠেলরা তো তাকে বেজায় মার দিল, তার কাছ থেকে চুরির মাল সমেত থলিটা
কেড়ে নিল গগন সাঁপুই। গগনের নির্দেশে মাথামোটা লক্ষণ আধমরা চোরটাকে ফেলতে গেল
বাঁশঝাড়ের পেছনের জঙ্গলে। লক্ষণ গগনের পাইক হলেও, মাঝেমধ্যে তার মাথায় ভাল-মন্দের
বিচারবুদ্ধি একটু একটু দেখা দেয়। সে চোরটাকে মাটিতে ফেলে যখন ভাবতে শুরু করেছে, যে এরপরে
চোরটাকে সাপে কামড়াবে কিনা,
অথবা তার জ্বর হবে কিনা, এখানে ফেলে রেখে যাওয়া উচিত হচ্ছে কিনা ইত্যাদি, সেই সময়ে
তার সামনে এসে উপস্থিত হলেন এক বিশাল লম্বা পুরুষ। তাঁর মাথায় বাবরি চুল, নাকের নিচে
পাকানো গোঁফ, কানে
মুক্তোর গয়না, পরনে
সাদা জোব্বা। লক্ষণের সাথে তাঁর কথাবার্তায় আমরা বুঝতে পারলাম যে যাকে চোর বলে
মেরে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে যাওয়া হল, সে আসলে চোর কিনা সেটা নিয়েই একটা সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
যাওয়ার আগে সেই পুরুষ লক্ষণ কে বলে গেলেন, তিনি হচ্ছেন শিমূলগড়ের অতি প্রাচীন
ভূত, তাঁর
নামা ছায়াময়। আর তাঁর সাথে লক্ষণের যে দেখা বা কথা হয়েছে, সেটা যেন
কেউ জানতে না পারে। সেই শুনে বোকা লক্ষণ খুব সাহস দেখিয়ে বিশ্বাস-টিশ্বাস করছিল না, কিন্তু যখন
সত্যি সত্যি তার চোখের সামনে থেকে ছায়াময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন, বুঝতেই পারছ
তার তখন কী অবস্থা হল।
ছায়াময় এর
পরে সোজা চলে এলেন অলঙ্কারের কাছে। তাকে ঘুমের মধ্যে জানিয়ে গেলেন, বাঁশঝাড়ের
পেছনের জঙ্গলে একটা জিনিষ আছে, সেটাকে তাকে খুঁজে আনতে হবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খিদে
পেটে অলঙ্কার গেল জঙ্গলে পেয়ারা খুঁজতে। সেখানে গিয়ে সে দেখতে পেল একজন অল্পবয়সী
যুবক সেখানে পড়ে ঘুমাচ্ছে। তাকে জাগিয়ে অলঙ্কার তাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে এল। এ হল
সেই 'চোর', যাকে আগের
রাতে লক্ষণ বাঁশঝাড়ের পেছনের জঙ্গলে ফেলে গেছিল। ছেলেটি অলঙ্কারের বাবা-মা'কে জানাল সে
মোটেও চোর নয়, সে
একজন প্রবাসী গবেষক,
যে পুরনো পুঁথি থেকে গুপ্তধনের হদিশ পেয়ে, সেই গুপ্তধন খুঁজতে শিমূলগড়ে এসেছে।
সে গুপ্তধন খুঁজেও পেয়ে গেছিল; তারপর নানা
ঘটনাচক্রে সে গগন সাঁপুইয়ের বাড়ি ঢুকে পড়ে। ধূর্ত গগন সাঁপুই তার গুপ্তধনের থলি
কেড়ে নেয়, আর
তাকে চোর বলে পেটায়। সে আরও জানায়, ওই গুপ্তধন আসলে অনেকগুলি প্রাচীন
সোনার মোহর, যেগুলির
ঐতিহাসিক মূল্য আজকের দিনে খুব বেশি।
কিন্তু গগন
সাঁপুই তো ওদিকে মতলব এঁটেছে সব সোনার মোহর গলিয়ে ফেলে, সোনা বিক্রি
করবে আর আরও বড়লোক হবে। তাহলে অলঙ্কারের নতুন বন্ধু গবেষক ইন্দ্রজিৎ দাদা কীভাবে
রক্ষা করবে দেশের এই অমূল্য সম্পদ? কার কার সাহায্য পাবে সে? ছায়াময় কি
তাকে সাহায্য করবেন?
কেন করবেন আর কীভাবে করবেন?
এই সব
প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই পাওয়া যাবে 'ছায়াময়' নামের
ছায়াছবিটি দেখলে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ২০১৩ সালে এই ছবিটি তৈরি
করেন হরনাথ চক্রবর্তী। সুর দিয়েছেন দেবজ্যোতি মিশ্র। আর অভিনয়ে আছেন পরাণ
বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী
চক্রবর্তী, দীপঙ্কর
দে, শান্তিলাল
মুখার্জি, দেবেশ
রায়চৌধুরী। সাথে ইন্দ্রজিতের ভূমিকায় গৌরব চক্রবর্তী আর ছোট্ট অলঙ্কারের ভূমিকায়
অধিরাজ গাঙ্গুলি।
'ছায়াময়' ভূতের ছবি
অবশ্যই, কিন্তু
'ছায়াময়' নিজে কিন্তু
মোটেও সেইরকম ভূত নন যাঁকে দেখলেই তুমি দাঁতকপাটি লেগে মূর্ছা যাবে। বরং ছায়াময় এক
বড়ই বুদ্ধিমান, সংবেদনশীল, ভাল ভূত।
তিনি ভাল মানুষদের সাহায্যই করেন, আর পাজি গগন সাঁপুইকে আচ্ছা করে শায়েস্তা করেন।
কথা হল, ছবিটা দেখবে
কীভাবে? এক
ডিভিডি যোগাড় করে দেখে নিতে পার, সেটাই স্বাভাবিক উপায়। আবার মাঝেমধ্যে 'ছায়াময়' ছায়াছবিটিকে
ইন্টারনেটেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে - কি করে সেটা জানি না বাপু - খুবই অদ্ভূতুড়ে
ব্যাপার আর কি!
_________
ছবিঃ
আন্তর্জাল
লেখক পরিচিতি - ছোটদের ওয়েব পত্রিকা ইচ্ছামতীর সম্পাদক-পরিকল্পক।
পেশাগতভাবে ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখা এবং অনুবাদের কাজ করেন।
ছায়াময় দেখার ইচ্ছেটা বেড়ে গেল।
ReplyDelete