
আমবাগানের ভূত
অভিজিৎ দাস
ম্যাজিক ল্যাম্পে নিজে ভয় পাওয়ার ঘটনা লেখার খবর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে জানতে পারলাম। অনেকে বলবেন ভয় মানে আজকাল আর ভূত হয় না। কিন্তু এই ভূতের ভয় দিয়েই বোধহয় মানবজাতির ভয়যাত্রা শুরু হয়। আমারও শুরু হয়েছিল। এই ঘটনা অনেককেই বলেছি। কেউ হেসে উড়িয়েছে, কেউ পুরোটা শোনার পর বলেছে মনের অস্বস্তির স্বীকার হয়ে ওসব দেখেছি। সবাই কি তার পুরো জীবনে সবকিছু দেখে যেতে পারে? সব অভিজ্ঞতা হয় কি তার? আমি লেখক নই। তবুও যেহেতু সবার পড়ার জন্য দিচ্ছি তাই কিছু গল্প আকারেই বলব। ভুল হলে মাফ করে দেবেন।
ঘটনা ২০ বছর আগে। এত দিনের আগের ঘটনা হলেও আমার মন ঘটনাটাকে ঠিক যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে। তবে ঘটনাকালের কিছু এমন অণু ঘটনা যা আমার তখনও মনে ছিল না - এখনও নয়। জটিল না করে বলি কী হয়েছিল।
আট বছর হবে আমার। বাড়িতে বাবা, মা, ঠাকমা, আর দাদু। মাঝে মাঝেই দাদু ঠাকমার ঝগড়া হত। বেশি ঝগড়া হলে ঠাকমা ঘরে খিল দিয়ে সারাদিন থাকত। আমি ঝগড়া বুঝতাম না। মনে হত ঠাকমার বুঝি শরীর খারাপ। যাই হোক এক শনিবার সকাল ১১টা। বাবা কাজে, মা নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ঠাকমা বড়ি দিচ্ছিল আমাদের বড় উঠানে। ঠাকমার বড়ি দেওয়া একটা নেশা। বড়ি দেওয়ার সময় ঠাকমা কোনও কথা বলত না। চারিদিক রোদ ঝলমলে। আমি বারান্দায় বসেছি সবে স্কুল থেকে এসে। স্কুলের সাদা জামা আর হাফ নীল প্যান্ট খুলিনি। দাদু আমাদের গ্রামের বড়ো পুকুর থেকে ছিপ দিয়ে একটা মাছ ঝোলাতে ঝোলাতে এসে বাড়ি ঢুকল। আর আমি দৌড়ে গিয়ে দেখতে গিয়ে ছিপে ধাক্কা লেগে মাছ গিয়ে পড়ল বড়ির পাত্রে। ব্যস, ঠাকমা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। অবশ্য আমার উপর নয়। দাদুর উপর। দাদুও ছাড়ার লোক নয়। শুরু হল ভয়ংকর যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের ফলে ঠাকমা বড়ির পাত্র নিয়ে দাদুর মুখে ছুড়ে মারল। আর ঠাকমা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। মা আমাকে বলল ঠাকমাকে আটকাতে। পিছু নিলাম। রাস্তা তখন এখনকার মতো নয়। পুরো ফাঁকা। আর আমাদের বাড়ি পাড়ার প্রায় শেষের তিন মাথার কাছে। একটা রাস্তা মুসলিম গ্রামের দিকে গেছে আর একটা গেছে সর্দার পাড়া। আর এই দুই রাস্তার মাঝে বিশাল ঘন আমবাগান। আর মূল রাস্তা চলে গেছে বড়ো রাস্তার দিকে। তিনটে রাস্তাই কাঁচা মাটির। বেরিয়ে বুঝতে পারলাম না কোন দিকে গেছে ঠাকমা। সর্দার পাড়ার রাস্তার দিকে এগোতেই দেখলাম ঠাকমার মতোই কে বাগানে। ওইতো ঠাকমা। ডাকলাম দুবার। উফ্ ঠাকমা যা রেগে আছে তাতে সাড়া দেবেই না। এমন বাড়ির থেকে কেন বেরিয়ে গেল? বাগানে ঢুকলাম। ঠাকমা কিন্তু কোনও দিকে না তাকিয়ে হন হন করে চলে যাচ্ছে। যেন ছুটছে। আমি পিছন থেকে ডেকেই চলেছি। “ও ঠাকমা, ঠাকমা।” কোনও সাড়া নেই। ২০ মিনিট হেঁটেও ধরতে পারলাম না আমার ছোট ছোট পায়ে। কোথায় গেল ঠাকমা? বসে পড়লাম। এবার ভয় করতে লাগল ওই জঙ্গলে একা। ঠাকমাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। ভর দুপুর হলেও ভিতরটা কী অন্ধকার লাগছিল! ওটা আমের সময়ও না। না হলেও কেউ বাগানে থাকত পাহারা দিতে। এখন কী করি? কোন দিক থেকে এলাম? এত দূর কোনোদিন আসিনি।
কী করব তখন ভেবেই পেলাম না। জানি না কত সময় এমন ভাবে কাটালাম কোন দিকে যাব এই ভেবে। তখন অন্য একটা ঠাকমা দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে বলল, “ও খোকা কোথায় যাবে?” আমার ভয়টা কাটল। বললাম, “আমার ঠাকমা হারিয়ে গেছে।” সে পাশের একটা গাছ দেখিয়ে বলল যে ওখানে আছে আমার ঠাকমা। আমি পাশে ওই গাছে তাকিয়ে দেখি আর একটা বুড়ি ওই গাছের ডালে দোল খাচ্ছে। আর হাসছে। শুধু সে নয় পাশে আরও একটা গাছে আর একজন। প্রত্যেকটা গাছে এক একজন বুড়ি। প্রত্যেকেই দোল খাচ্ছে আর হাসছে। আর সবাই সাদা থান পরা। হাসি ক্রমশঃ বেড়ে কানে ঝালাপালা ধরে গেল। চোখ বন্ধ করে বসে পড়লাম। চোখ খুলে দেখি সবাই আমাকে ঘিরে। ঠাকমাও আছে। ঠাকমা নাকি বাড়ির পিছনেই গিয়েছিল ঝগড়ার পর। আমাদের শোবার ঘরেই শুয়ে আছি। আমাদের পাড়ার মন্টুধোপা মুসলিম পাড়ায় কাপড় দিয়ে ফেরার পথে আমাকে ডোবার ধারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তখুনি বাড়ি নিয়ে আসে ঘাড়ে করে। সারা শরীরে আমার ব্যথা তিন দিন ছিল। পরে সবাইকে বলেছিলাম কী হয়েছিল। শুনে দাদুই আমাকে এক জায়গা থেকে ওঝা দিয়ে ঝাড়িয়ে এনেছিল। আর ঠাকমা বলেছিল, “আমি আর কখনও ঝগড়া করব না।” সত্যি তারপর থেকে বাড়িটা শান্ত থাকত। কিন্তু ওই আমবাগানে কী করে এসব হল তা আমাকে কেউ কখনও বলেনি। আজ সেই আমবাগান নেই।

______
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment