
সম্ভাবনার অংক
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
আঁতোয়ার বিপদ
“আঁতোয়া, তুমি তো বন্ধু মানুষ। তা কোন কায়দায় রোজ রোজই জুয়োর বোর্ড থেকে জিতে ফেরো বল দেখি!”
রাত হয়েছে। পারি শহরের ঘিঞ্জি গলির ভেতর এই জুয়ার আড্ডার খেলাধুলো আজকের মত শেষ। ঠান্ডা পড়েছে বেশ আজ। সন্ধের মুখে বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তায় থকথকে কাদার ওপর হালকা বরফের সর পড়েছে। দেখলে মনে হবে শক্ত, কিন্তু অসাবধানে পা দিলে দুর্গন্ধ কাদায় পা ডুবে যায়।
আঠালো কাদা থেকে জুতো টেনে তুলতে তুলতে আঁতোয়া গঁব মাথা নাড়ল, “শিখিয়ে দিচ্ছি। কায়দাটা হঠাৎ করেই মাথায় এসেছিল, বুঝলে! একটা ছক্কা চারবার গড়িয়ে দেব। আর বাজি ধরব যে ওর মধ্যে অন্তত একটা ছক্কা পড়বেই।”
“ব্যস! ওইতেই জিতে যাব? যত্তোসব গাঁজাখুরি কথা।”
“না হে বন্ধু। কেমন করে ব্যাপারটা হয় জানি না, কিন্তু কোনও দিন যে হেরে ফিরি না সে তো দেখতেই পাচ্ছ। নিজে করে দ্যাখো না!”
বন্ধুবর খানিক ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “নাঃ। তুমি আমায় আসল কথাটা বলছ না ভায়া। চেপে যাচ্ছ স্রেফ।”
“চেপে যাচ্ছি? ঈশ্বরের দোহাই। বন্ধু হয়ে বন্ধুর সঙ্গে ছল করবার বান্দা নয় হে তোমাদের আঁতোয়া!”
“বাজে বোকো না তো! বলতে চাইছ এককথায় নিজের রুজিরোজগারের কায়দাটা আমায় জানিয়ে দিলে? তা কখনো হয়? কেউ দেয়?”
তার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আঁতোয়া হো হো করে হেসে ফেললেন, “ওহো। এই ব্যাপার? না হে বন্ধু। ঘটনাটা হল, কাল থেকে আমি আর এ বাজিটা ধরবই না বলে ঠিক করে ফেলেছি। সেইজন্যেই কায়দাটা তোমায় উপহার দিলাম। আমি কাল থেকে নতুন বাজিতে খেলব।”
“অ্যাঁ? এমন একটা কায়দা — তুমি ছেড়ে দেবে?”
“হ্যাঁ বন্ধু। এতে রোজ জিতি বটে, কিন্তু লাভ বড়ো কম। এক ফ্রাঁ করে বাজি ধরে একশোটা গেম খেললে দিনপ্রতি ঘরে লাভ হয় চার ফ্রাঁ। দিনে চার ফ্রাঁ একটা লাভ হল? কপাল ঠুকে নতুন কায়দাটা করে দেখি একবার। কী হয়!”
মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বন্ধুটি। আঁতোয়া উঁচুবর্গের মানুষ। দিনে চার ফ্রাঁ তাঁর কাছে কিছু না হলেও, বন্ধুটির মত গরিব মানুষের কাছে ওইই ঢের। খানিক বাদে তিনি ফের বললেন, “তা নতুন কায়দাটা কী সেটা শুনতে পাই?”
“ওইটি হচ্ছে না বন্ধু। এ আমার মন্ত্রগুপ্তির ব্যাপার।”
“নিশ্চিন্তে বলে ফেলো হে। জুয়ো খেলি বটে, কিন্তু বন্ধুর পিঠে ছুরি? কভি নেহি। ও কায়দা তোমারই থাকবে।”
আঁতোয়া বন্ধুর দিকে চেয়ে দেখলেন একবার। ছেলেবেলার দোস্ত। একে বিশ্বাস করা যায়।
“শোনো বলি। ঠিক করেছি এইবারে জোড়া ছক্কা ছুঁড়ে বাজি ধরব। চব্বিশবার ছক্কাজোড়া ছোঁড়া হলে একবার জোড়া ছয় পড়বেই, এইটেই আমার বাজি। লম্বা গেম হবে। বাজিও বেশি ধরা হবে ওতে। লাভও বেশিই থাকবে।”
*****
কিন্তু ভাগ্যদেবী এইবার নিরাশ করলেন জুয়ারি আঁতোয়াকে। আপাতদৃষ্টিতে সবারই মনে হবে এই দ্বিতীয় কায়দাটায় জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি। চারবারের জায়গায় চব্বিশবার ছুঁড়ে একজোড়া ছক্কা - সে আর এমন কী ব্যাপার? বাস্তবে কিন্তু দেখা গেল, উল্টোটা ঘটছে। বন্ধুটি যখন দিব্যি রোজরোজ জিতে বাড়ি ফিরছেন তখন আঁতোয়ার কপালে প্রায় প্রতিদিনই হারের উৎসব চলছে। মাস গেলে হিসেবনিকেশ সেরে যখন দেখা গেল, সব মিলে বেশ খানিকটা টাকা লোকসানেই গেছে তখন আঁতোয়ার চমক ফিরল। ব্যাপারখানা কী?
নিজের বুদ্ধিতে এ রহস্যের সমাধান হল না দেখে আঁতোয়া কাগজকলম নিয়ে বসলেন একখানা চিঠি লিখতে—
পাস্কালের হিসেবনিকেশ
সন ১৬৫৪। সে সময়কার নামকরা বিজ্ঞানী পাস্কাল একদিন একখানা চিঠি পেলেন। পণ্ডিত মানুষ। তাঁর চিঠিপত্তর সাধারণত পণ্ডিতদের কাছ থেকেই আসে। কিন্তু এ চিঠির লেফাফা খুলে দেখা গেল সেটা লিখেছেন পারি শহরের এক রইস। পড়াশোনার দুনিয়ায় তাঁর যাতায়াত নেই মোটেই। চিঠির বিষয় জুয়াখেলার হারজিত। কী চায় এ? পাস্কাল একটু আশ্চর্য হলেও চিঠিটা খুলে পড়লেন মন দিয়ে।
আর তারপরেই, সব ছেড়েছুড়ে কাগজকলম টেনে নিলেন কাছে। রহস্যটা তাঁকেও খানিক চমকে দিয়েছে।
তবে পারি শহরের জুয়ারিকে বোকা বানালেও সে রহস্যের পাস্কালের সঙ্গে লড়বার মত জোর ছিল না। অচিরেই রহস্যের সমাধান হল। পাস্কাল খানিক যোগবিয়োগের অংক কষে আঁতোয়াকে বুঝিয়ে দিলেন কেন এমনটা হচ্ছে, আর তার থেকে কী করেই বোঝা যাবে জুয়াতে কেমনটা বাজি ধরলে তাতে জেতার আশা বাড়বে না কমবে।
কেমন করে সেইটে করলেন পাস্কাল তাকে বুঝতে একটু যোগবিয়োগ করে দেখা যাক। যারা যোগবিয়োগ গুণভাগ এই চারটে অংক জানো না তারা অংকগুলো বাদ দিয়ে যেতে পারো অনায়াসে। চলে যেতে পারো পরের গল্পের সুতো ধরেই সটান। আর যারা ও চারটে অংক শিখে ফেলেছ, তারা এ অংকগুলো দেখলে এইসান মজা পাবে যে ভাবতে পারবে না।
একটা ছক্কা একবার চাললে তাতে হয় এক বা দুই বা তিন এমনি করে ছরকমভাবে পয়েন্ট পড়বার চান্স আছে তাইতো? তার মধ্যে যে কোন একটা পয়েন্ট, (ধরো সেটা পাঁচ বা ছয় বা দুই) সেটা পড়বার চান্স হচ্ছে ছ ভাগের এক ভাগ, মানে ১/৬ (মানে প্রায় সতেরো শতাংশ)। আর সেটা না পড়বার চান্স হলো ৬ বারের মধ্যে ৫ বার, মানে ৫/৬ (বা প্রায় তিরাশি শতাংশ)
ছক্কাটা যদি দুবার চালো? কতরকমভাবে তাতে পয়েন্ট পড়বে? দেখো কী ঘটছেঃ

মোট ৬x৬ মানে ছত্রিশভাবে পয়েন্ট পড়তে পারে। ওর মধ্যে কতগুলোতে একটা বা তার বেশি ছয় পড়েছে গুণে দেখো দেখি? এগারোবার তাইতো? তাহলে ছক্কাটা দুবার চাললে বা দুটো ছক্কা একসঙ্গে চাললে তাতে ছত্তিরিশবারের মধ্যে পঁচিশবার ছয় বাদে অন্য কিছু পড়ছে মানে আঁতোয়ার ওতে হারার চান্স ২৫/৩৬। (৬৯শতাংশ) আর জেতার চান্স তাহলে ১১/৩৬ মানে ৩১ শতাংশ।
ছোট্ট করে বললেঃ
১ বার চাললে আঁতোয়ার হারার সম্ভাবনা ছয়ের ভেতর পাঁচ= ৫/৬ = ৮৩ শতাংশ
২বারচাললে আঁতোয়ার হারার চান্স ২৫/৩৬= (৫x৫)/(৬x৬) = ৬৯ শতাংশ
এবারে
চালের সংখ্যা
|
আঁতোয়ার হারের চান্স
|
শতাংশ
|
১
|
৫/৬
|
৮৩
|
২
|
৫x৫/৬x৬
|
৬৯
|
৩
|
৫x৫x৫/৬x৬x৬
|
৫৮
|
৪
|
৫x৫x৫x৫/৬x৬x৬x৬
|
৪৮
|
তার মানে ছক্কাটা চারবার চাললেই আঁতোয়ার হারের সম্ভাবনা অর্ধেকের থেকে কম হয়ে যাচ্ছে।
এবারে সে ধরো প্রতি গেমে এক ফ্রাঁ বাজি রেখে খেলছে। তাহলে দিনে একশোখানা গেম খেললে এই হিসেবে তার হারবার কথা ৪৮ বার তাতে সে হারবে ৪৮ ফ্রাঁ। আর জেতবার চান্স তাহলে ৫২ বার। তাতে তার মানে বাহান্ন ফ্রাঁ তার আয় হবে। নিট লাভ দিনে চার ফ্রাঁ।
এবার আঁতোয়ার দু নম্বর কায়দাটা দেখা যাক। এখানে একসঙ্গে দুটো ছক্কা চালা হচ্ছে।
দুটো ছক্কা একবার চাললে কী কী উঠতে পারে? একটা ছক্কা দুবার চাললেও যা হবে, দুটো ছক্কা একবার চাললেও তাই। ফল হবে

ওতে জোড়া ছক্কা পড়ছে ছত্তিরিশবারের মধ্যে মাত্র একবার। তার মানে দুটো ছক্কা একবার চাললে তাতে আঁতোয়ার হারবার চান্স ৩৬ এর মধ্যে ৩৫, বা ৩৫/৩৬
আর জেতবার চান্স হল ১/৩৬—মানে [১-(৩৫/৩৬)], তাইতো?
এবারে এতে ওপরের কায়দাটা লাগিয়ে দেখা যাক জোড়া ছক্কার চালের সংখ্যা বাড়লে আঁতোয়ার হারের চান্স কেমন করে বাড়ে?
চালের সংখ্যা
|
আঁতোয়ার হারের চান্স
|
শতাংশ
|
১
|
৩৫/৩৬
|
৯৭
|
২
|
৩৫x৩৫/৩৬x৩৬
|
৯৪.৫
|
৩
|
৩৫x৩৫x৩৫/৩৬x৩৬x৩৬
|
৯২
|
৪
|
৩৫x৩৫x৩৫x৩৫/৩৬x৩৬x৩৬x৩৬
|
৮৯
|
২৪
|
৩৫২৪/৩৬২৪(মানে ওপরে ২৪খানা ৩৫ গুণ আর নীচে ২৪ খানা ৩৬ গুণ)(মোবাইলের ক্যালকুলেটার লাগবে)
|
৫১
|
তার মানে চব্বিশ চালের গেম যদি আঁতোয়া একশোবার খেলে তাহলে তাতে ৫১টা গেমে সে এক ফ্রাঁ করে হারছে, আর জিতছে ৪৯টা গেমে। নিট ক্ষতি দিনে দু ফ্রাঁ।
পাস্কাল, ফার্মা আর আরও কয়েকজন
আঁতোয়ার সমস্যা তো মিটল এভাবে। কিন্তু ওদিকে নাওয়াখাওয়া তখন মাথায় উঠেছে ক্ষ্যাপা বিজ্ঞানীর। জুয়াখেলার সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর দৃষ্টি তখন ছুটেছে অনেক দূরে। কেন বলো দেখি? কারণ হল, অ্যাদ্দিন জুয়াকে বলা হত ভাগ্যের খেলা। তাতে কে যে কখন জিতবে আর কে যে হারবে তা বলা মানুষের সাধ্য ছিল না। কিন্তু আঁতোয়ার সমস্যাটার সমাধান করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন নেহাত ভাগ্যের খেলাকেও অংকের হিসেবে বেঁধে ফেলে মোটামুটি সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করে ফেলা যায়। হিসেব করে বলে দেয়া যায় ঠিক কীভাবে খেললে জেতার সম্ভাবনা বেড়ে উঠবে অনেকখানি।
এইভাবেই প্রথম দানা বেঁধেছিল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে অংকের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলার চিন্তা। বিষয়টা নিয়ে পাস্কাল এইবারে চিঠি লিখলেন সে সময়ের আর এক তুখোড় বিজ্ঞানী ফার্মা-কে। ফার্মাও মেতে উঠলেন এই নতুন অংকের রহস্য নিয়ে। চিঠির উত্তরপ্রত্যুত্তরে গড়ে উঠতে শুরু করল সম্ভাব্যতা তত্ত্ব বা প্রোবাবিলিটি থিওরি নামে গণিতের এক নতুন শাখা- আগামীদিনে যা মানুষকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে অংকের আলোয় তার কর্মকাণ্ডের ভবিষ্যতকে তার সামনে খানিকটা হলেও তুলে ধরে।
এর কয়েকবছর পরে ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হিউজেনস্ পাস্কাল আর ফার্মার সেইসব চিঠিপত্রের খবর পেলেন। সেই কথোপকথনের থেকে অংকের ভিত্তিটাকে ছেঁকে নিয়ে ১৬৫৭ সালে বের হল সম্ভাব্যতা গণিতের প্রথম বই De Ratiociniis in Ludo Aleae। তবে সে বই মূলত বিভিন্ন ধরণের জুয়া বা গেম অব চান্সের ফলাফলের ভবিষ্যতবাণীর সূত্রকেই গাণিতিক রূপ দিয়েছিল।
এরপর দুই শতাব্দী ধরে প্রবাবিলিটি তত্ত্ব নিয়ে প্রচুর কাজকর্ম চলল। ক্রমেই আরও উন্নত হয়ে উঠল তার ভবিষ্যৎবাণীর মান। উল্লেখযোগ্য গবেষণা করলেন বারনৌলি, ডি ময়ভারের মত গণিতজ্ঞরা।
জীবনে খুব কম বিষয়ই মোটামুটি নিশ্চিত হয়। যেমন ধরো সকালবেলা সূর্য পুবদিকে মুখ জাগাবে আর বিকেলে অস্ত যাবে পশ্চিমে, দিনের নির্দিষ্ট সময়ে জোয়ার ভাঁটা সেগুলো তো মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু তুমি আজ যে ম্যাচটা খেলতে যাচ্ছ তাতে তুমি জিতবে না হারবে, কিংবা যে খেলনাটা তুমি কিনতে চাইছ সেইটে তুমি দোকানে পৌঁছোনোর সময় স্টক থাকবে না থাকবে না এইরকম প্রায় সমস্ত জিনিসই কিন্তু আগে থেকে একেবারে নিশ্চিত করে বলা যায় না। বলা যায় না বিজ্ঞানী যে মহাকাশযানটাকে রওনা করালেন আজ সেইটে একেবারে হিসেবমত চাঁদের কোলে গিয়ে পৌঁছোবে না পৌঁছোবে না, কিংবা যে ওষুধটা আবিষ্কার করার গবেষণা চলেছে ভয়ানক কোনো অসুখের জন্যে সেইটে কার্যকরী হবে না হবে না। এমনিভাবে, জীবনের পদেপদেই তো রয়েছে কতোরকমের অনিশ্চয়তা। জুয়ারির প্রশ্নের মুখে পড়ে পাস্কাল সেই প্রথম অজ্ঞাত ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে অংকের যুক্তি দিয়ে মেপে ফেলবার কাজ শুরু করায় মানুষ তার বাঁচামরার সব বিষয়ে ভগবানের ওপর অন্ধভাবে ভরসা করা ছেড়ে দিয়ে নিজের ভাগ্যকে নিজেই অংকের পথে আন্দাজ করবার পথে প্রথম পা বাড়াল।
উনিশ শতকে এসে প্রবাবিলিটি তত্ত্বের গবেষণা নতুন মোড় নিল আর এক বিজ্ঞানীর হাত ধরে। তিনি পিয়ের ডি লা প্লাস। দূরদর্শী এই বিজ্ঞানী গেম অব চান্সের জুয়াখেলার আওতার বাইরে জীবনের আরও অনেক ক্ষেত্রে এই শক্তিশালী তত্ত্বের প্রয়োগ আন্দাজ করেছিলেন সাফল্যের সঙ্গে। জীবনের আর আর যত এলাকায় যত অনিশ্চয়তা আছে, যেখানে মানুষ ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অসহায় হয়ে বসে থাকে সেইখানেও একটা লোকের কপালে ভালোমন্দ কী ঘটবে তার আন্দাজ যদি দিতে পারে এই নতুন যুক্তির অংক তাহলে মানুষের জীবনের ভোলটাই বদলে যাবে যে!
কোথায় কোথায় বন্ধু হতে পারে প্রোবাবিলিটির হিসেব?
আচ্ছা বলতে পারবে, কোন কোন ক্ষেত্রে একে কাজে লাগানো যায়? শোনো বলি। একটা আন্দাজ দিচ্ছি তোমাদের। ধরো একটা কারখানা বসাতে চলেছেন কেউ। তার জিনিসপত্তর বিক্রি হবে কি হবে না সেইটে আগে থেকে কে বলে দেবে? সেও তো সেই জুয়াখেলার মতই ভাগ্যের ওপর ভরসা করে নিজের সম্পদকে বাজি ধরা। জিতলে রাজা। হারলে ফকির। কিন্তু গণেশঠাকুরের দয়ার ওপর ছেড়ে না দিয়ে যদি এমন কোন অংক কষে বলে দেয়া যায় যে তাঁর কারখানার লাভ করবার সম্ভাবনা কতখানি আছে, বা আন্দাজ কত বছর সময় নেবে সে কারখানা লাভের মুখ দেখবার জন্যে তাহলে মানুষটা নিজের সম্পদ তাতে ব্যয় করবেন কি করবেন না সে ব্যাপারে বেশ খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে কাজে নামতে পারবেন।সঠিকভাবে সাজিয়ে নিতে পারবেন নিজের কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনাকে।
কিংবা ধরো কোন প্রিয় মানুষের একটা কঠিন অসুখ হয়েছে। সে অসুখের দু তিনটে নতুন ওষুধ বেরিয়েছে বাজারে। এই নতুন অংক যদি কোনভাবে একটা আন্দাজ দিতে পারে এর কোন ওষুধটায় তাঁর বাঁচবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তাহলে সেইটে কত উপকারী হয় বলো?
অথবা ধরো তোমাদের বাড়িতে একটা উৎসব হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ নিমন্ত্রিত। তাঁদের মধ্যে অনেকে আসবেন, অনেকে আসবেন না। ঠিক কতজনের মত খাবারদাবার বানানো দরকার সেই নিয়ে বাবা আর মায়ের জোর আলোচনা চলছে। এইখানেও, আগে ঘটে যাওয়া এ ধরণের অনুষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য জুটিয়ে নিলে প্রোবাবিলিটি তত্ত্ব মোটামুটি কত লোক হাজির হতে পারে তার আন্দাজ দিতে পারে। বেঁচে যেতে পারে অনাবশ্যক খরচ।
এ তত্ত্ব আন্দাজ দিতে পারে সরকারের হাতে দেশটাকে চালাবার জন্য পরের বছরে মোটামুটি কত হাজার কোটি টাকা কর আসতে পারে। আন্দাজ করতে পারে আগামী বছরে ঠিক কতটা ফসল উঠবে দেশের শষ্যাগারে কিংবা কতটা বৃষ্টি হবে চাষের মরসুমে। তার ওপরে ভরসা করে সরকার তৈরি করতে পারে দেশের উন্নতির পরিকল্পনা। ভগবানকে ডাকবার দরকার পরে না।
১৮১২ সালে লা প্লাস তাঁর বিখ্যাত Thérie Analytique des Probabilités তে প্রথম দেখালেন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সমাধানে সঠিক আন্দাজ দেবার জন্যে কীভাবে এই নতুন তত্ত্বকে কাজে লাগানো যায়। এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ভুলের তত্ত্ব। সে ভারী মজার জিনিস। ধরো তুমি একটা শ্রেণীর জিনিসের ওজন, দৈর্ঘ এইসব, বা একটা কোন ঘটনা কখন ঘটবে, কীভাবে ঘটবে, একটা কোম্পানি কত লাভ করবে না করবে সেই ব্যাপারে একটা মাপজোক তৈরি করেছ, বা অন্য কথায় কোন একটা বস্তু বা ঘটনাকে দৈর্ঘ, ওজন, টাকা, সময় এইসবের ভিত্তিতে মাপছ। সে মাপজোক কখনোই একেবারে নিখুঁত হতে পারে না। কিছু না কিছু ভুল তাতে থাকবেই। যে পরিমাণ ভুল তাতে থাকতে পারে সেইটের হিসেব যদি তুমি না কষতে পার তাহলে তোমার কাজটার সাফল্য অসাফল্য ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। ছোট্টো একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরো পৃথিবী থেকে ভারতের মহাকাশযান যাচ্ছে মঙ্গলগ্রহে। মহাকাশে সব্বাই তো বেজায় দৌড়ে বেড়ায়। এই মুহূর্তে এইখানে আছে তো পরের মুহূর্তে আরেক জায়গায়। তাহলে বছরখানেক ধরে ছুটে তোমার যান যখন মঙ্গলে পৌঁছোবে তখন সে গেছোদাদা ঠিক কোনখানে থাকবে সেইটে হিসেব করে সেইমতো যানের অভিমুখ তুমি বাঁধবে, তাইতো? তাতে ধরো অংক বলল, পৃথিবীর ঘূর্ণনতলের সঙ্গে ৩১.৯৮৭ ডিগ্রি কোণ করে যানকে রওনা করালে সে ঠিক সময়ে গিয়ে ঠিকঠাক মঙ্গলের কাছে পৌঁছোবে। অতোবড়ো বস্তুটা আকাশে উঠে যখন মুখ ঘোরাবে তখন যদি তাতে ধরো দশ হাজার ভাগের এক ভাগ ত্রুটিও ঘটে যায় তাহলে যেটুকু অভিমুখ বদলাবে সেইটে, যখন সে লক্ষলক্ষ মাইল পড়ি দিয়ে মঙ্গলে পৌঁছোবে তখন বেজায় বড়ো ত্রুটি হয়ে দাঁড়াবে। রকেট আর মঙ্গলকে খুঁজেই পাবে না তখন। উড়তে উড়তে মহাকাশে হারিয়েই যাবে। সঙ্গে ছবিটা দেখলে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে -

ধরো রকেটকে ‘ক’ রাস্তাটা ধরতে হবে। আর সে ধরল ‘খ’ রাস্তাটা। শুরুর বিন্দুতে ত্রুটিটা এতই ছোটো যে প্রায় চোখেই পড়ে না। অথচ ওরই জন্যে যাত্রাশেষে সে গোটা গ্রহটার নাগালই পেল না আর।
থিওরি অব এরর করে কি, কোনও হিসেবে ঠিক কতটা ভুল হবার সম্ভাবনা আছে সেইটেকে একটা হিসেব কষে দেয় প্রোবাবিলিটিকে কাজে লাগিয়ে। তার ফলে বিজ্ঞানীরা আগেভাগেই সেইমত বন্দোবস্ত নিতে পারেন যাতে ভুলটার প্রভাবটাকে আটকানো যায়।
এছাড়া আজকের বিজ্ঞানের একটা শক্তিশালী ভিত্তিপ্রস্তর স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিকসের গোড়ায় সম্ভাবনাতত্ত্বের প্রয়োগের দিকটা দেখিয়েছিলেন লা প্লাস। বড়ো হয়ে তোমরা জানতে পারবে কীভাবে পদার্থবিদ্যার এক মহা গুরুত্বপূর্ণ ধারা তাপগতিবিদ্যা, পশ্চিমে আজকের আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল। তাপ থেকে গতির সৃষ্টি করেই তো আধুনিক সভ্যতার জয়রথ ইঞ্জিনের সৃষ্টি! সেই তাপগতিবিদ্যা বা থার্মোডাইনামিকসের বিদ্যের জয়যাত্রার পেছনেও কিন্তু রয়েছে সম্ভাব্যতা তত্ত্বের প্রয়োগে গড়ে ওঠা এই স্ট্যাটিসটিকাল মেকানিকস।
বিন্দু থেকে সিন্ধু, পরমাণুর অন্দরের কোয়ার্ককণাদের গতিবিধি থেকে অতিকায় নক্ষত্ররাজদের আচারব্যবহার, মারণ রোগের ওষুধ থেকে নতুন টেলিভিশন সেটের বিক্রির হিসেব, চাষের ক্ষেতের বৃষ্টির ভবিষ্যতবাণী থেকে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের সৃষ্টি, সাগরজলের স্রোতের স্বভাব থেকে মহাকাশযানের যাত্রাপথ এই সবকিছুতেই আগামীতে কী হতে চলেছে বা কতটা সাফল্য অসাফল্য হতে পারে, কতটুকু ভুলচুক ঘটতে পারে, সেইসব অদেখা ভবিষ্যতকে অংকভিত্তিক পূর্বাভাষের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলে সম্ভাব্যতা তত্ত্ব নামের গণিতের এই শাখা আজ বিজ্ঞানকে জাদুকরের দণ্ডের পর্যায়ে তুলে নিয়ে চলেছে ক্রমশ। সভ্যতাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে চলেছে নিরন্তর।
------------
durdanto laglo
ReplyDeletevalo laglo. Discrete distribution?
ReplyDeleteঅনবদ্য পাঠ অভিজ্ঞতা ... আধুনিক বিজ্ঞানে সম্ভাব্যতার গণিত যে এক স্বকীয় বৈশিষ্ঠে উজ্জ্বল তারই মনোজ্ঞ বিবরণ।
ReplyDeletehub valo laglo, onek kisu shihar moto.
ReplyDeleteদারুন লাগল! অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ।
ReplyDelete