
অতীতের তীর হতে
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
‘ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোঅস্মি দিবাকরম্।।’
আঃ! মুহূর্তে একটা তেজোদীপ্ত তৃপ্তি যেন ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গ জুড়ে। প্রাচীদিগন্তের বিপুল রক্তিমাভার মধ্যে স্বর্ণপাত্রের ন্যায় উজ্জ্বল ঐ একখন্ড মহামহিম গোলকই এ শক্তির উৎস, তিনি জানেন। তাই প্রত্যহ ঊষালোকে ধৌত মনপ্রাণে এই একটি নিবিড় নিবেদন, এই প্রগাঢ় প্রণতিই রঘুনাথকে মুক্তি দেয়, তাঁকে প্রাত্যহিক সততায় উজ্জীবিত করে।
রঘুনাথ শিরোমণি। বর্তমান নবদ্বীপের পন্ডিতসমাজের প্রত্যাশার দীপাধার। অনায়াসেই তাঁর প্রতি এই বিশ্বাস অর্পণ করা যায় যে, অদূর ভবিষ্যতে তিনি নবদ্বীপবাসী পন্ডিতকুলেরও ‘শিরোমণি’ হয়ে উঠবেন।
আর সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার প্রথম সোপানে পদার্পণের জন্যই রঘুনাথ গত কয়েকদিন যাবৎ শ্রান্তিহীন পদযাত্রা শুরু করেছেন এই বিপদসঙ্কুল অরণ্যবর্ত্মে; লক্ষ্য তাঁর — কালের সংকেতবাহী, ঐতিহ্যময় শিক্ষার পীঠভূমি — মিথিলা।
# # # # #
এই দুর্গম যাত্রাপথের ভয়াবহতা সম্বন্ধে রঘুনাথ যে অজ্ঞ ছিলেন তা নয়, বরং তিনি এই দীর্ঘ পথের মধ্যস্থ কিছু অরণ্য ও বিরল জনপদ এবং তাদের অধিবাসীদের সম্পর্কে বিশেষরকম অবহিত ছিলেন। এমনকি অরণ্যপথে অতর্কিত দস্যু বা তস্করের আবির্ভাবের সম্ভাবনা সম্পর্কেও তিনি জ্ঞাত ছিলেন সম্পূর্ণরূপে। তাই নিজের জন্য এই কয়েকদিনের গ্রাসাচ্ছাদনের উপযোগী কিছু শুষ্ক খাদ্য, একটি ক্ষুদ্র জলপাত্র এবং একটি উত্তরীয় ভিন্ন আর কিছুই সঙ্গে রাখেননি।
অবশ্য তাঁর পরনের পরিধেয় বস্ত্রটির এককোণে বাঁধা আছে আর একটি আপাতক্ষুদ্র বস্তু, যা প্রকৃতপক্ষে রঘুনাথের প্রাণস্বরূপ। সেটি আর কিছুই নয়, বর্তমান নবদ্বীপের পন্ডিতসমাজের চূড়ায় যাঁর অবস্থান, সেই মহামহোপাধ্যায় হৃষীকেশ বেদান্তবাগীশ মহাশয় প্রদত্ত তুলট কাগজে লেখা একখানি অভিজ্ঞানপত্র, যা রঘুনাথকে সসম্মানে স্থান করে দেবে মিথিলার মহাবিদ্যালয়ে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নের নিমিত্ত আগত ছাত্রদের সারিতে। তাই তুলটখন্ডটিকে অবিকৃত রক্ষার ব্যাপারে রঘুনাথের সর্বান্তিক প্রচেষ্টার অন্ত নেই।
কিন্তু শুধু কি এই? রঘুনাথ কি কেবল ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নের নিমিত্ত মিথিলায় গমন করছেন? না। তাঁর হৃদয়ের নিভৃতে সুপ্ত হয়ে থাকা এক দীর্ঘ আকাঙ্খিত বাসনা প্রতিনিয়ত ক্রীড়া করে চলেছে। রঘুনাথ ক্রমশ দৃঢ়চেতা হয়ে উঠছেন। আর তাঁর সঙ্কল্প ক্রমেই সকলের অগোচরে নিজ উদ্দেশ্যসিদ্ধির সোপানে পা রাখছে।
বনরাজি ক্রমেই ঊষালোকে পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। রঘুনাথ ধীরে ধীরে জলাশয় হতে তীরে পদার্পণ করলেন। পরিধান করলেন তাঁর পরিধেয় ও উত্তরীয়। নিকটস্থ বৃক্ষ হতে আহরণ করলেন ফলরাজি। সেই বৃক্ষেরই তলে উপবিষ্ট হয়ে গ্রহণ করলেন কিছু ফলমূল, জলপাত্র দ্বারা জলপান করলেন, তারপর বাকি ফলমূলগুলি তাঁর একমাত্র বস্ত্রকুন্ডলীতে শুষ্ক খাদ্যগুলির সঙ্গে একত্রে বেঁধে ফেলে তৎপর হয়ে উঠলেন যাত্রা শুরুর জন্য।
এই যাত্রাপথের শুরু থেকেই যে প্রশ্ন রঘুনাথের মনকে বারবার নিপীড়িত করছিল, আজ খাদ্যগ্রহণের অবসরে আবার একবার তা নিয়ে বিব্রত হলেন রঘুনাথ। মিথিলায় ঠিকমতো যদি পৌঁছেও যান তিনি, এই অভিজ্ঞানপত্রের দৌলতে যদি বা অধ্যাপকেরা তাঁকে শিক্ষার্থী হিসেবে মেনেও নেন, সহপাঠী ছাত্ররা তাঁকে সহজে গ্রহণ করবে তো? কারণ ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাসে তিনি যে জন্মাবধি একচক্ষুহীন! এই নিরপরাধ অক্ষমতার জন্য তাঁকে লাঞ্ছনার মুখোমুখি হতে হবে না তো?
যাত্রা শুরু করার সময় আগত। পুনরায় একবার চোখ তুলে রঘুনাথ তাকালেন জ্যোতির্ময় সূর্যের দিকে, তারপর ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন তাঁর গন্তব্য অভিমুখে। গোপন সঙ্কল্পে আর সুদৃঢ় মনোবলে বজ্রকঠিন তাঁর মুখমন্ডল।
# # # # #
কিছুদিন পর। বহু ক্লেশ সহ্য ক’রে, নানা বিপদের সম্মুখীন হয়ে সেই বিপদ স্বীয় বুদ্ধিবলে কাটিয়ে অবশেষে রঘুনাথ উপনীত হলেন মহান মিথিলার পাদপীঠে। দূর থেকে ওই সৌধ দৃষ্টিপথে আসামাত্র দাঁড়িয়ে পড়লেন অবাক বিস্ময়ে। সহস্র কাহিনী যেন নিমেষে ভিড় করে এল মনে।
এই সেই মহাবিদ্যালয়। যুগ যুগ ধ’রে সারা ভারতবর্ষ থেকে অগণিত শিক্ষার্থী শিক্ষা-আকাঙ্খায় এখানে আগমন করছে — কেউ পদব্রজে, কেউ গো-শকটে ; কিন্তু সকলের স্থান সংকুলান হবার মতো ততো বিশাল নয় এর অন্তস্থ পরিসর। তদুপরি এখানেও রয়েছে কিছু ব্যক্তিগত তদ্বির প্রথা, রয়েছে জাতিভেদের দুর্মর বাধা। তাই নিরাশমুখে ফিরতে হয় অনেককেই।
কিন্তু কী সেই কারণ, যার দুর্নিবার আকর্ষণে এত শিক্ষার্থীর এখানে সমাবেশ?
রঘুনাথ তা জানেন। তিনি এও জানেন যে সকলকে স্থান দেওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয় বলেই এই ছদ্ম-আয়োজন জাতিভেদ-প্রথার। এবং এর মূলে রয়েছে যে ঘৃণ্য মনোবৃত্তি, সেই একাধিপত্যের জঘন্য চেষ্টার প্রতিই রঘুনাথের ঘৃণা।
এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর আগমন যে বিষয়কে কেন্দ্র করে, তা হল ন্যায়শাস্ত্র। মিথিলাই সারা ভারতের একমেবাদ্বিতীয়ম্ স্থান, যেখানে ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা হয়। এবং এই শাস্ত্রের পঠনপাঠন যাতে অন্যত্র কোথাও না যায়, কেবল মিথিলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, শুধু সেজন্যই অধ্যাপকরা ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করান কেবল শ্রুতির মাধ্যমে। কোনও শিক্ষার্থীকে পাঠ লিখে নিতে দেন না। শুধুমাত্র এই কারণেই, অন্য কোনও বিষয় নয়, কেবল ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষার জন্যই মিথিলা অত্যাবশ্যকীয় স্থান হিসেবে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য।
রঘুনাথও আজ এসে পৌঁছলেন ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্যই। অন্যান্য শাস্ত্র তাঁর পঠিত হয়ে গিয়েছে নবদ্বীপে থাকাকালীনই। এবার ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন সমাপ্ত করলেই তিনি সর্বশাস্ত্রে সুপন্ডিত হয়ে উঠবেন আর নবদ্বীপের নব্য পন্ডিত হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠে দেশের পন্ডিতসমাজের মুখোজ্জ্বল করবেন।
ভাবতেই গর্বে বক্ষদেশ ফুলে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর সুপ্ত বাসনার কথা মনে পড়ায় প্রতিজ্ঞায় কঠোর হয়ে ওঠে তাঁর অন্তর। সুবিশাল এক কর্ম যে তাঁর বাকি রয়েছে এখনও! সমগ্র দেশের প্রতি এক অবিচল কর্তব্য যে তাঁর হস্তক্ষেপের অবরুদ্ধ প্রতীক্ষায় দিন গুনছে!
না, বৃথা কালক্ষেপ তিনি করবেন না। তাতে কোনও ফললাভ হয় না। মুষ্টিবদ্ধ হাতে শপথের আকাঙ্খা লুকিয়ে রঘুনাথ প্রবেশ করেন মহাবিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে।
# # # # #
দিন যায়। অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন রঘুনাথ ন্যায়শাস্ত্র পঠনপাঠনের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে চলেন।
প্রথম অবস্থায় তাঁকে বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর ভাগ্যে। একচক্ষুহীন হওয়ার নির্দোষ অপরাধে সহশিক্ষার্থীরা সকলেই তাঁকে একপ্রকার ঘৃণাবশত দূরে ঠেলে রেখেছিল, কিন্তু অবিচল রঘুনাথ ধীরে ধীরে স্বীয় পান্ডিত্যের আকর্ষণে আকৃষ্ট করেন সকলকে, এবং একসময় দেখা যায়, কখন যেন নিজেরই অগোচরে তিনি সকলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন।
মাত্র কয়েকমাস। সমূহ ন্যায়শাস্ত্র রঘুনাথের কন্ঠস্থ হয়ে গেল। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ন্যায় পঠন এবং পন্ডিত হিসেবে শিরোপা পাওয়া মাত্র নয়; সমগ্র ন্যায়শাস্ত্রকে রঘুনাথ অত্যন্ত আন্তরিক প্রচেষ্টায় অধীত করলেন এমনভাবে, যাতে ন্যায়শাস্ত্রের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোনও সূত্র, পাদটীকা বা অপ্রয়োজনীয় কোনও অংশও তিনি না ভোলেন।
অধ্যাপকরা প্রতিদিন ঠিক যেমন যেমন ক্রমান্বয়ে শ্লোকের পর শ্লোক ও তার অর্থ বুঝিয়ে দিতেন প্রাঞ্জলভাবে, প্রতি রাত্রে একান্ত নিভৃতে রঘুনাথ সেই সমস্ত পাঠ পুনরায় রোমন্থনের ন্যায় একে একে সাজিয়ে নিতেন তাঁর মস্তিষ্কের পরতে পরতে। আর এ বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করল তাঁর অকল্পনীয় স্মৃতিশক্তি।
তবে তিনি অধ্যাপকদের সম্মুখে কখনোই তাঁর অধীত বিদ্যার সম্পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ হতে দিতেন না। কারণ তাঁর অন্তর্লোকে যে প্রতিজ্ঞার অগ্নিশিখা স্ফূলিঙ্গরূপে তখন জাজ্বল্যমান ছিল, তার সম্পূর্ণতা পাবার পক্ষে তাতে বাধা পড়া অসম্ভব ছিল না।
# # # # #
মিথিলায় রঘুনাথের বসবাসের দিন সমাপ্ত। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পঠন শেষ করার ফলে মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই রঘুনাথ মুক্তি পেলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাসের কোনও অসুবিধা ছিল না; বরং অধ্যাপকরা ও সহশিক্ষার্থীরা তাঁকে সেই অনুরোধই করেছিলেন বারংবার। কিন্তু মনের মধ্যে শপথের স্ফুলিঙ্গ তখন মশালরূপ ধারণ করেছে। কর্ম উন্মাদনায় তোলপাড় চলছে রঘুনাথের অন্তরে। তাই দ্রুত সকলের অনুরোধ এড়িয়ে রঘুনাথ যাত্রা শুরু করলেন নবদ্বীপের পথে।
পরের ঘটনা, ইতিহাসের বিচারে বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ হলেও, কাহিনী হিসেবে নিতান্তই সংক্ষিপ্ত।
মিথিলাবাসের কয়েকটা মাস রঘুনাথ ন্যায়শাস্ত্রের যে সমগ্র অংশ সাজিয়ে রেখেছিলেন তাঁর অত্যাশ্চর্য মস্তিষ্কের অণুতে অণুতে, তা উজাড় করে দিলেন পুঁথির পাতায়। এবং রঘুনাথ শিরোমণির এই নতুনভাবে লিপিবদ্ধ করা ন্যায়শাস্ত্র থেকেই ভারতীয় শিক্ষাজগতে উন্মোচিত হল নবদিগন্ত — মিথিলার একাধিপত্য গেল খর্ব হয়ে, নবদ্বীপ হয়ে উঠলো নব্য ন্যায় পঠন পাঠনের লীলাভূমি।
--------------------
ছবি - আন্তর্জাল
লেখক পরিচিতি - কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আকৈশোর সঙ্গী সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই তাঁর বেঁচে থাকা। তাই একাধারে অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকা ছড়া, কবিতা ও গল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়ে চলা নাটক ও নৃত্যনাট্য রচনা, সুরারোপ ও সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে বিচ্ছুরিত তাঁর প্রতিভা। বেশ কিছু পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখকের নানা বিষয়ের গ্রন্থরাজির মধ্যে ‘আরশিনগর’, ‘আলাদিন’, ‘ছড়াডুম সাজে’, ‘নির্বাচিত শ্রুতিনাট্য’, ‘ভূতের বৃন্দাবন’ প্রভৃতি বইগুলি ইতিমধ্যেই পাঠকসমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে।
Eta amar jana chilo na, bhalo laglo
ReplyDelete