
স্থানটি বড়ো মনোরম। তিনদিক থেকে তিনটি নদী এসে এখানে মিলিত হয়েছে। গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী।
এই তিন নদীর বারিধারা তিন বর্ণের। অথচ এই মহাসঙ্গমে এসে তারা একসঙ্গে মিলে গিয়ে সৃষ্টি করেছে একটিই বর্ণ। যেন তিনটি বাদ্যযন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন শব্দতরঙ্গ মিলিয়ে মিশিয়ে সৃষ্টি করে চলেছে একই ঐকতান, একই সুরমূর্চ্ছনা।
এই স্থানের নাম প্রয়াগ। আর এই প্রয়াগের সঙ্গমস্থলেই আজ চলছে সাজো সাজো রব। হস্তীর বৃংহিত, অশ্বের হ্রেষা আর মানুষের কলরবে চারিদিক মুখরিত। ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে তূরী ও ভেরী। দামামার শব্দে চারিদিক সচকিত। জনাকীর্ণ প্রান্তরের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র রক্ষীপ্রহরা। পদস্থ রাজকর্মচারীদের দ্রুত পদচারণা। আর তারই মধ্যে অতি সাধারণ দুঃস্থ জনগণের বিস্মিত জমায়েত। সব মিলিয়ে এ এক মহামেলা। দানধ্যানের এক পুণ্য উৎসব। এক ঐতিহাসিক মহাসঙ্গম।
গত পঁচাত্তর দিন ধরে এ মেলা চলছে। ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ তাঁদের আকাঙ্ক্ষার পাত্র পূর্ণ করে ফিরে গেছেন যে যার দেশে। আজ এই অন্তিম দিবসে শুধু অবশিষ্ট আছেন আরো কিছু মানুষ, যাঁরা ঐ দারুনির্মিত দানমঞ্চের অদূরে রজ্জুর সীমানার বাইরে প্রতীক্ষারত। এই মাত্র কয়েকশত মানুষের দানপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই এবারের মতো শেষ হবে এই দানের উৎসব। সমাপ্তি ঘটবে দীর্ঘ আড়াই মাস ব্যাপী এই পঞ্চবার্ষিকী মেলার।
হ্যাঁ। এরকমই হয়ে আসছে বিগত বেশ কিছুকাল। গোটা আর্যাবর্তের মানুষ এখন জেনে গেছেন যে, প্রয়াগের তীরে এই পুণ্যভূমিতে তিনি আসবেন প্রতি পাঁচ বৎসরে একবার, আয়োজন হবে এই বিশাল উৎসবের, আর সেই পাঁচ বৎসরে অর্জিত তাঁর যাবতীয় নিজস্ব সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে তিনি ফিরে যাবেন তাঁর রাজধানী কনৌজে, শুরু করবেন আবার তাঁর রাজার ভূমিকা, একেবারে শূন্য থেকে।
সেই আয়োজনই চলছে এখন। সঙ্গমের তীরে সাময়িকভাবে তৈরী করা বিশাল গৃহগুলির অভ্যন্তরে স্তূপীকৃত ছিল যে রাশি রাশি স্বর্ণ, রৌপ্য, মহার্ঘ পোশাক-পরিচ্ছদ আর খাদ্যসামগ্রী, তা এখন প্রায় নিঃশেষ। সামান্য কিছু যা অবশিষ্ট আছে, সেগুলি এই মুহূর্তে জমায়েত করা চলছে ঐ দানমঞ্চের উপর। আজ স্বহস্তে সেগুলি বিতরণ করে নিঃস্ব, রিক্ত, কপর্দকশূন্য হয়ে ফিরে যাবেন সেই রাজা, পুষ্যভূতি বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট, রাজা প্রভাকরবর্ধনের সুযোগ্য পুত্র সম্রাট হর্ষবর্ধন।
সহসা উচ্চনাদে বেজে উঠলো ভেরী। রক্ষীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল দুইভাগে বিভক্ত হয়ে। অদূরে স্কন্ধাবারের সামনে যেন সহসা জেগে উঠলো চাঞ্চল্য। সম্রাট হর্ষবর্ধন অবিচলিত পদক্ষেপে স্কন্ধাবার থেকে বেরিয়ে এলেন। হর্ষধ্বনি জেগে উঠলো জনতার মধ্যে। সম্রাট এগিয়ে চললেন মঞ্চের দিকে। সঙ্গে রয়েছেন রাজমহিষী এবং রাজভগ্নী। আর তাঁদের অনুগমন করছেন সম্রাটের অনুগত বিভিন্ন প্রদেশের রাজারা।
দানসামগ্রী প্রস্তুত। মঞ্চে আরোহণ করে সম্রাট তাকালেন পার্শ্ববর্তী ময়দানের দিকে। সেখানে পাশাপাশি তিনটি স্বর্ণমূর্তি রক্ষিত। বুদ্ধমূর্তি, সূর্যমূর্তি ও মহাদেবের মূর্তি। সম্রাটের আরাধ্য তিন দেবতা। মেলার প্রথম তিন দিন পর্যায়ক্রমে ঐ তিন মূর্তিপূজার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল উৎসবের প্রস্তুতি। প্রতিদিনের মতো আজও তাই নতমস্তকে সেই দেবতাদের চরণে প্রণতি জানালেন সম্রাট। বেজে উঠলো শঙ্খধ্বনি। শুরু হল ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী মেলার সমাপ্তি উৎসব।
# # # # #
বেলা দ্বিপ্রহর। শ্রান্ত, ক্লান্ত সম্রাটের ভান্ডার অবশেষে শূন্য হল। শেষ প্রার্থীর হাতে সম্রাট তুলে দিলেন তাঁর শেষ দান – একটি স্বর্ণদন্ড। এটি হাতে নিয়েই সম্রাট বিচারসভা পরিচালনা করতেন। শুধু দন্ড নয়, এটি তাঁর মনোবল ও বীরত্বের পরিচায়কও বটে। অথচ কি আশ্চর্য, তাঁর প্রতিনিধিস্বরূপ সেই রাজদন্ড এক সম্পূর্ণ অপরিচিতের হাতে তুলে দিয়েও তাঁর চিত্ত অকুন্ঠ, হাসি অমলিন! তাকালেন পার্শ্বে দন্ডায়মান রাণী দুর্গাবতীর দিকে। তাঁর মুখেও খেলে গেল এক রহস্যময় হাসি। উজ্জ্বল দুটি চোখের ভাষা যেন কথা বলে উঠল। তিনি যে বহুদিন ধরে মহারাজকে চেনেন! সম্রাটের এই সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হবার আনন্দের তিনিও যে এক অংশীদার!
সহসা সম্মুখে রক্ষীপ্রহরার মধ্যে একটা কোলাহল। রাজা দৃষ্টি প্রসারিত করলেন।
প্রার্থী জনতার দল এখন আর নেই। শুধু রজ্জুসীমানা পেরিয়ে এগিয়ে আসতে চায় এক অশীতিপর বৃদ্ধা, কিন্তু রক্ষীদের বাধা পেরিয়ে একবিন্দুও অগ্রসর হতে পারে না। রক্ষীরা জানে, দানধ্যানের পালা সমাপ্ত, তাই সেনাধ্যক্ষের নির্দেশে তারা আর কাউকে রজ্জুসীমানায় প্রবেশ করতে দেবে না।
রাজার ইঙ্গিতে সরিয়ে নেওয়া হল বাধা। অতিকষ্টে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন বৃদ্ধা। কিন্তু লোলচর্ম সেই বৃদ্ধার আকুতি শুনে সম্রাট বিব্রত, বিপর্যস্ত। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসেছে এই দীনদরিদ্র, অসহায় নারী, সার্বভৌম সম্রাটের কাছ থেকে সামান্য কিছু পাবার আশায়।
কী করবেন এখন সম্রাট? কুন্ঠিত নতমুখে চিন্তা করেন কিছু সময়। তারপর সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর চোখ। ভগ্নী রাজ্যশ্রীর দিকে ফিরে অনুচ্চস্বরে কিছু বলেন। আর এরপরেই দেখা যায় এক আশ্চর্য দৃশ্য। ভগ্নীর হাত থেকে নিয়ে অতি সাধারণ এক বস্ত্র পরিধান ক’রে সম্রাট তাঁর নিজের রাজবেশ ও উত্তরীয় সযত্নে তুলে দেন বৃদ্ধার হাতে। মুহূর্তে তূরী-ভেরী-দামামার জয়নাদে চারিদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আকাশ বাতাস মুখরিত হয় সমবেত প্রজাদের জয়ধ্বনিতে – ‘জয়তু সম্রাট! চিরং জীবতু সম্রাট!! জয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের জয়!!’
# # # # #
এই হলেন হর্ষবর্ধন। দানবীর, প্রজাপালক, সুশাসক সম্রাট হর্ষবর্ধন। ৫৯০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। ৬০৬ থেকে ৬৪৭ খ্রীষ্টাব্দ, এই সুদীর্ঘ ৪১ বৎসর তিনি সুনামের সঙ্গে রাজত্ব করেছেন গোটা উত্তর ভারত জুড়ে। শাসক হিসেবে, রাজা হিসেবে তিনি যে অনন্য, তার পরিচয় তাঁর ১,০০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য আর ৬০,০০০ হস্তীবাহিনীর বিশালত্বে। এমনকি জীবদ্দশায় তাঁর রাজধানী কনৌজ হয়ে উঠেছিল উত্তর ভারতের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র।
আবার এরই পাশাপাশি যখন জানা যায়, এই রাজাধিরাজ সম্রাটের হাতেই সৃষ্টি হয়েছে সংস্কৃত নাটক ‘নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ আর ‘প্রিয়দর্শিকা’, তখন এক বিমূঢ় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় মন। একজন মাত্র মানুষের পক্ষে এ কি করে সম্ভব?
তাই তো তাঁরই সভাকবি বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’ কিংবা চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-য়ের ভ্রমণকাহিনী তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ভারত ইতিহাসের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে – রাজ্যশাসনে, প্রজাপালনে, দানধ্যানে ও বীরত্বে যাঁর তুলনা একমাত্র তিনি স্বয়ং – মহামহিম সম্রাট, শিলাদিত্য হর্ষবর্ধন।

_____
ছবি - পুষ্পেন মণ্ডল
লেখক পরিচিতিঃ কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার । আকৈশোর সঙ্গী সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই তাঁর বেঁচে থাকা । তাই একাধারে অসংখ্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকা ছড়া, কবিতা ও গল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়ে চলা নাটক ও নৃত্যনাট্য রচনা, সুরারোপ ও সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে বিচ্ছুরিত তাঁর প্রতিভা । বেশ কিছু পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখকের নানা বিষয়ের গ্রন্থরাজির মধ্যে ‘আরশিনগর’, ‘আলাদিন’, ‘ছড়াডুম সাজে’, ‘নির্বাচিত শ্রুতিনাট্য’, ‘ভূতের বৃন্দাবন’ প্রভৃতি বইগুলি ইতিমধ্যেই পাঠকসমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে ।
No comments:
Post a Comment